

বাংলাদেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম খাত দ্রুত বর্ধমান ও অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি শিল্প। কিন্তু এই খাতের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির পথে রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ; যেগুলো সমাধান না করলে দেশের স্বাস্থ্য খাতের সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। বর্তমান সময়ে সরকার দেশের স্বাস্থ্য খাতের কার্যকর সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে চিকিৎসা সরঞ্জাম শিল্পের সমস্যাগুলো বিশ্লেষণ-পূর্বক প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা প্রদান করে দেশের স্বাস্থ্যসেবায় ভিন্নমাত্রা যোগ করা সময়ের দাবি।
দীর্ঘদিন ধরে দেশের স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং অপার সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র, চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি আমরা গুটিকয় প্রতিষ্ঠান। আমরা বাংলাদেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি নির্মাতা ও রপ্তানিকারকদের নিবন্ধিত সংগঠন, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর মেডিকেল ডিভাইসেস অ্যান্ড সার্জিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স (বিএএমডিএসআইএমই)। আমাদের সমস্যা কী, কেন নতুন উদ্যোক্তারা এই শিল্পে বিনিয়োগে অনাগ্রহী, পুরোনোরা কেন ছেড়ে যাচ্ছে, ওষুধ শিল্পে সাফল্যের বিপরীতে চিকিৎসা সরঞ্জাম শিল্পের চিত্র কেন বিপরীত? এসব বিষয় যথাযথ কর্তৃপক্ষকে বিবেচনায় আনতে হবে। এই শিল্পের বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ আর অযুত সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করতে হবে। কেননা আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার ভিত্তিই হলো সুরক্ষিত ও কার্যকর মেডিকেল ডিভাইস। ডায়াগনস্টিক যন্ত্রপাতি, ইমেজিং মেশিন, সার্জিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট, হাসপাতাল সরঞ্জাম, সিরিঞ্জ, আইভি সেট, পিপিই এসব ডিভাইস ছাড়া আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা কল্পনাই করা যায় না।
বিশ্ববাজার ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা
২০২৫ সালে বৈশ্বিক মেডিকেল সরঞ্জাম এবং যন্ত্রাংশের বাজারের মূল্য প্রায় ৫০১ থেকে ৭০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি, যা ২০৩০ সালের মধ্যে ৮০০ বিলিয়ন থেকে ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ বাজারের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি হার প্রায় ৫-৮ শতাংশ হলেও হাল আমলের ডিজিটাল স্বাস্থ্য, পরিধানযোগ্য প্রযুক্তি এবং এআই-সক্ষম ডিভাইস খাতে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশিত।
বৈশ্বিক এই পরিস্থিতিতে আমরা যদি বাংলাদেশের দিকে তাকাই, তখন দেখতে পাই, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের মেডিকেল ডিভাইস ও ইক্যুইপমেন্ট খাতে বাজারের আকার প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা (মার্কিন ডলার হিসেবে প্রায় ২.৫ বিলিয়ন)। প্রতি বছর গড়ে ১৫ শতাংশ হারে এ বাজারের প্রসার ঘটছে। এটি বাংলাদেশের ১৪ বিলিয়ন ডলারের বৃহত্তর স্বাস্থ্যসেবা খাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যার মধ্যে রয়েছে হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক ল্যাব, ওষুধ ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা।
২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা বাজার ২৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর পূর্বাভাস রয়েছে। সে সময় মেডিকেল ডিভাইস ও ইক্যুইপমেন্ট খাতের বাজারের আকার দাঁড়াতে পারে প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকা (মার্কিন ডলার হিসেবে যা ৪ বিলিয়নেরও বেশি)।
বাংলাদেশের বর্তমান বাজার
এমন সম্ভাবনাময় একটি খাত হওয়া সত্ত্বেও এই শিল্পের বিকাশ হচ্ছে না। আমদানিনির্ভর পরিকল্পনায় নষ্ট হচ্ছে সব সম্ভাবনা। আমাদের মেডিকেল ডিভাইসের প্রায় ৮৫-৯০ শতাংশ আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ করা হয় যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীনসহ নানা দেশ থেকে। দেশীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের পরিমাণ মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ। এর ফলে বিদেশি মুদ্রার ওপর চাপ পড়ছে এবং আন্তর্জাতিক সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে।
নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আছে আশা জাগানিয়া অগ্রগতি। ১৯৯৫ সালে অপসো স্যালাইন বাংলাদেশে মেডিকেল ডিভাইস সেক্টরে পথপ্রদর্শক হিসেবে তাদের উৎপাদন কারখানা প্রতিষ্ঠা করে। এর পরবর্তী পর্যায়ে, ১৯৯৯ সালে জেএমআই সিরিঞ্জেস অ্যান্ড মেডিকেল ডিভাইসেস লিমিটেড (জেএসএমডিএল) এ শিল্পে যোগ দেয়। এর পর থেকে নানা সময়ে বাজারে আসা নিপ্রো জেএমআই কোম্পানি লিমিটেড, জেএমআই হসপিটাল রিকুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড, এএনসি, লিব্রা ইনফিউশনস, গেটওয়েল, ইনসেপ্টা হসপিকেয়ার, প্রোমিক্সকো, নিপ্রো জেএমআই মেডিকেল লিমিটেড, জেএমআই ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্যাস, ডিবিএল, তাইওয়ান বাংলা মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট, একিউরা বায়োটেকনোলজি, শেফতা মেডিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান প্রমাণ করেছে যে, যথাযথ বিনিয়োগ, উন্নত প্রযুক্তি এবং সমর্থনমূলক নীতিমালা থাকলে বাংলাদেশে শক্তিশালী এবং প্রতিযোগিতামূলক দেশীয় মেডিকেল ডিভাইস শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব। এমনকি এসব শিল্পে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়াও সম্ভব।
দেশের বাজারে বর্তমানে কার্ডিওলজি ও ইনটেনসিভ কেয়ার ডিভাইস, নলিকাগত রোগ নির্ণয় (আইভিডি), মেডিকেল ইমেজিং ও স্ক্যানিং যন্ত্রপাতি, গৃহ স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ যন্ত্রপাতি, ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা ও পরিধানযোগ্য প্রযুক্তি (যেমন স্মার্ট ঘড়ি, স্মার্ট চশমা ইত্যাদি) পণ্যের দ্রুত বিকাশ ঘটছে। এর নেপথ্যে রয়েছে নতুন হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট ক্লিনিকের সংখ্যা বৃদ্ধি, ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ অসংক্রামক রোগের বিস্তার, জনসচেতনতা ও আয় বৃদ্ধির হার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডিজিটাল স্বাস্থ্য ও দূর চিকিৎসায় (টেলিমেডিসিন) বিনিয়োগ বৃদ্ধি।
রপ্তানি সম্ভাবনা
দেশীয় প্রতিষ্ঠানের অনেকেই আন্তর্জাতিক সিই মার্কিং, আইএসও- ১৩৪৮৫ ও ৯০০১, জিএমপি কমপ্লায়েন্স এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রাক-যোগ্যতা প্রক্রিয়া সার্টিফিকেশন অর্জন করেছে। সিরিঞ্জ, ইন্ট্রাভেনাসলি (আইভি) সেট, রক্ত সংগ্রহের টিউব সেট, পিপিইর মতো পণ্য এখন ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার ৪০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এসব সাফল্য প্রমাণ করে, আমরা শুধু নিজেদের চাহিদা মেটাতে নয়, বিশ্ববাজারে নির্ভরযোগ্য রপ্তানিকারক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সক্ষমতাও রাখি।
শিল্প বিকাশে যত বাধা
অফুরন্ত সম্ভাবনার মেডিকেল ডিভাইস শিল্পকে গড়ে তুলে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের মেডিকেল ডিভাইস উৎপাদন ও রপ্তানির পথে আমাদের যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—সরকারি নীতিমালায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতা ও অসম্পূর্ণ বাস্তবায়ন, কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে উচ্চ শুল্ক, অপর্যাপ্ত তথ্য, স্বচ্ছতা ও সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব, গবেষণা এবং উন্নয়নে ও উদ্ভাবনে সীমিত বিনিয়োগ, বাজারে খণ্ডিত কাঠামো এবং দুর্বল স্টেকহোল্ডার ইন্টিগ্রেশন।
চাই নীতি সহায়তা
বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের দাবি—বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সহায়তায় এই শিল্পে কর মুক্তি দিতে হবে। চিকিৎসা সরঞ্জাম খাতে আমাদের প্রতিযোগী দেশ ভারত ও চীন নিজেরাই কাঁচামাল উৎপাদনকারী। অন্যদিকে, আমাদের কাঁচামাল বেশিরভাগ আমদানিনির্ভর। এ অবস্থায় দেশীয় শিল্পের বিকাশে চিকিৎসা সরঞ্জাম খাতের রপ্তানিতে বিদ্যমান ৬ শতাংশ নগদ প্রণোদনা বাড়িয়ে অন্তত ২০ শতাংশ করতে হবে এবং এই সুবিধা ন্যূনতম ১০ বছর বহাল রাখতে হবে। তৈরি পোশাক শিল্প এবং ওষুধ শিল্প থেকে অর্জিত আমদানি, উৎপাদন ও রপ্তানি অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। বুয়েট, কুয়েট, এমআইএসটিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল ডিভাইস উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত বিষয়গুলো পাঠ্যক্রমভুক্ত করতে হবে কিংবা আলাদা বিভাগ চালু করতে হবে।
এ ছাড়া নীতিনির্ধারকদের প্রতি আমাদের আহ্বান—মেডিকেল ডিভাইসেস ও সার্জিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টস খাতকে আলাদা শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। এই শিল্পের বিকাশে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করতে হবে। ডিজিডির অধীনে নিয়ন্ত্রক কাঠামো শক্তিশালী করতে হবে। এইচএস কোডে সততা বজায় রেখে আমদানিতে শুল্ক জালিয়াতি রোধ করতে হবে। সরকারি হাসপাতাল ও কর্মসূচিতে দেশীয় পণ্যের সর্বজনীন ক্রয় (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট) উৎসাহিত করতে হবে। তৈরি পোশাক শিল্প ও ওষুধ রপ্তানিকারকের মতোই চিকিৎসা সরঞ্জাম বা যন্ত্রাংশ রপ্তানিকারকদের জন্য প্রণোদনা চালু করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে দেশে উৎপাদিত পণ্যের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য সমন্বয় করা হচ্ছে না বিধায় উৎপাদনকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে কাঁচামালের দাম বেড়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় মূল্য সমন্বয় না হলে উৎপাদকরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। তাই অতি দ্রুত দেশে উৎপাদিত পণ্যের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) সমন্বয় করতে হবে।
এসব সুবিধা পেলে বাংলাদেশের মেডিকেল ডিভাইস শিল্প দেশের অর্থনীতি ও জনস্বাস্থ্যের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক শক্তি হতে পারে। স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে আমদানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দেশ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে পারবে এবং বিভিন্ন দেশ থেকে নিম্নমানের ডিভাইসের অবৈধ আমদানি বন্ধ হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ও জনস্বাস্থ্যের জন্য সম্ভাবনা
বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর হাজারো বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার ডিগ্রি অর্জন করছেন। কিন্তু তাদের জন্য যথাযথ কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। এ অবস্থায় বাংলাদেশের মেডিকেল ডিভাইস শিল্পের পূর্ণ বিকাশ হলে এ খাতে লাখো কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। নিরাপদ ও সাশ্রয়ী মূল্যের চিকিৎসা সরঞ্জাম দেশজুড়ে সহজলভ্য হওয়ার ফলে স্বাস্থ্যসেবার মানও উন্নত হবে। বাংলাদেশের উৎপাদন খরচ তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় রপ্তানির ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। পরিকল্পিত বিনিয়োগ, কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং উপযুক্ত নীতিমালা এই খাতকে দেশের টেকসই অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করবে।
পরিশেষে আমাদের আহ্বান, আসুন সবাই মিলে গড়ে তুলি একটি শক্তিশালী, উদ্ভাবনী এবং রপ্তানিমুখী মেডিকেল ডিভাইস শিল্প, যা দেশের চাহিদা পূরণ করে, মেটাবে বৈশ্বিক চাহিদা। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেবে বাংলাদেশের নাম।
সভাপতি, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর মেডিকেল ডিভাইসেস অ্যান্ড সার্জিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স (বিএএমডিএসআইএমই)। প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জেএমআই গ্রুপ
মন্তব্য করুন