

একুশে পদকপ্রাপ্ত কৃষি অর্থনীতিবিদ। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) থেকে কৃষি অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থানসহ বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। লন্ডন থেকে পিএইচডি ও অক্সফোর্ডে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা সম্পন্ন করে পাঁচ দশক বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা ও গবেষণা করছেন এবং বিভাগীয় প্রধান, অনুষদীয় ডিন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। তিনি বাকৃবির প্রথম ইমেরিটাস অধ্যাপক। তিনি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (বিআইডিএস) প্রফেসরিয়াল ফেলো হিসেবে গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন। বাংলাদেশের কৃষির বর্তমান অবস্থা, সংকট, সম্ভাবনা এবং ভবিষ্যৎ রূপকল্প নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন
বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতি বর্তমান কোন পর্যায়ে রয়েছে? এটি কি রূপান্তরের শুরুতে, নাকি এক ধরনের স্থবিরতায়?
এম এ সাত্তার মণ্ডল: দেশের কৃষি অর্থনীতি কখনোই পুরোপুরি স্থবির ছিল না। এর প্রবৃদ্ধি কখনো কম, কখনো বেশি—এ ধারা সবসময়ই চলমান ছিল। এটি একটি চলমান রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছে। তবে রূপান্তরের গতি কখনো কখনো কিছুটা ধীর হয়। এ মুহূর্তে প্রযুক্তির ব্যবহার, গবেষণা এবং বিশেষ করে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের গতি কিছুটা শ্লথ মনে হচ্ছে। এ কারণে আমাদের পুরো বাজার ব্যবস্থাটি গভীরভাবে বিশ্লেষণের একটি ব্যাপার রয়েছে। তবে সার্বিকভাবে আমি মনে করি, কৃষির রূপান্তর প্রক্রিয়া ঠিক পথেই চলছে।
প্রায়ই শোনা যায়, কৃষি খাতের উৎপাদন বাড়লেও কৃষকের আয় সেভাবে বাড়ছে না। এর মূল বাধাটা কোথায়?
এম এ সাত্তার মণ্ডল: কৃষকের আয় বাড়ছে না, এ কথাটি যেমন ঠিক, তেমনি কোনো কোনো পণ্যে যে আয় বাড়ছে, সেটাও ঠিক। এখানেই আধুনিক ও বাণিজ্যিক কৃষির সুবিধা-অসুবিধাগুলো বোঝার ব্যাপার রয়েছে। আমাদের কৃষি এখন আর শুধু খোরপোশের পর্যায়ে নেই; কৃষক এখন বাজারের জন্য এবং লাভের জন্যই উৎপাদন করে। কিছু কিছু পণ্য যেমন পাট, যা খাদ্য তালিকার বাইরের একটি বৃহৎ কৃষি পণ্য, সেগুলোর বাজার গত চার বছরে তেমন সম্প্রসারণ হয়নি। ফলে কৃষকরা লাভবান হননি। কিন্তু অন্যদিকে তৈলবীজ (তিল, কালিজিরা) বা পেঁয়াজের মতো ফসলে কৃষকরা লাভবান হয়েছেন, যদিও পেঁয়াজের বাজারে দামের ওঠানামা বেশ লক্ষণীয়।
আপনি প্রধান ফসল ধানের কথা বলছিলেন। চালের দাম বাড়লেও কৃষকের লাভ হচ্ছে না, এর পেছনে রাজনৈতিক অর্থনীতি কী?
এম এ সাত্তার মণ্ডল: ধানের বিষয়টি বেশ জটিল। চালের দাম মোটামুটি বাড়তির দিকে থাকলেও কৃষকের লাভ নিশ্চিত হচ্ছে না, কারণ উৎপাদন খরচ বেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি দ্রুতগতিতে। এর প্রধান কারণগুলো হলো:
১. শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি: ভরা মৌসুমে কৃষি শ্রমিকের সংকট এবং চড়া মজুরি একটি বড় বিষয়।
২. উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি: রাসায়নিক সার, কীটনাশক এবং সেচকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির ভাড়া—সবকিছুর দাম বেড়েছে।
৩. নগদ অর্থের সংকট: এখন কৃষির প্রায় সব উপকরণই বাজার থেকে নগদ অর্থে কিনতে হয়। কিন্তু কৃষকদের হাতে সবসময় প্রয়োজনীয় নগদ অর্থ থাকে না এবং কৃষিঋণও পর্যাপ্ত নয়।
এই ত্রিমুখী সংকটের কারণে চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে কৃষকের হাতে লাভ থাকছে না।
উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত এই দীর্ঘ শৃঙ্খলে চালকল মালিক ও মধ্যস্বত্বভোগীদের ভূমিকা কতটা?
এম এ সাত্তার মণ্ডল: আমি এদের মধ্যস্বত্বভোগী না বলে ‘মার্কেটিং এজেন্ট’ বা বাজার ব্যবস্থাপনার অংশ বলতে চাই। ধান থেকে চাল তৈরির প্রক্রিয়ায় চালকল মালিকদের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে এবং বাজারের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভরা মৌসুমে তারাই বেপারিদের মাধ্যমে ধানের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে তারাই ধানকে চালে রূপান্তর করে বাজারে ছাড়েন। বেপারিরাও কৃষক, তাই ধানের দামের ওঠানামায় তাদেরও লাভক্ষতির ব্যাপার আছে। ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্ন কৃষকদের পক্ষে এই বাজার ব্যবস্থায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলা কঠিন। এ কারণে বাজারের সংকটকে কৃষকের লাভ না হওয়ার একটি বড় কারণ।
৫৪ বছরের যাত্রাপথে বাংলাদেশের কৃষি বড় ধরনের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। জমির পরিমাণ কমছে, শিল্পায়ন বাড়ছে। এ সময়ে কৃষির কাঠামোগত রূপান্তর নিয়ে আপনার ভাবনা কী? আমাদের কোন নীতি নিয়ে এগোনো উচিত?
এম এ সাত্তার মণ্ডল: বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলি। সত্তর বা আশির দশকে খামারের আয়তন যত বড় হতো, এককপ্রতি উৎপাদনশীলতা তত কম হতো। কারণ তখন সনাতন প্রযুক্তিতে বেশি পরিমাণ জমি ব্যবস্থাপনা করা কঠিন ছিল। অন্যদিকে, ক্ষুদ্র চাষিরা পারিবারিক শ্রম দিয়ে নিবিড় চাষের মাধ্যমে বেশি ফসল ফলাতেন। এখন চিত্রটা পুরোপুরি উল্টে গেছে। বাংলাদেশে এখন পৌনে দুই কোটি কৃষক পরিবারের প্রায় দেড় কোটিই ক্ষুদ্র। উত্তরাধিকার আইনের কারণে বড় ও মাঝারি খামারগুলো ভেঙে যাচ্ছে এবং ক্ষুদ্র কৃষকের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এই ক্ষুদ্র কৃষকদের অনেকেই আবার ‘পার্টটাইম’ বা খণ্ডকালীন কৃষক। তারা নিজেদের অল্প জমি আবাদের পাশাপাশি অন্যের জমি বর্গা বা বন্ধকি নিয়ে চাষ করছেন। ফলে, তাদের ফলন বাড়ানোর সাধ থাকলেও নগদ অর্থ ও সময়মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করতে না পারায় ফলন তেমনটা বাড়ছে না। অন্যদিকে, যারা বেশি জমি একত্রে চাষ করছেন, খামারের কার্যকর আয়তন বাড়িয়ে তাদের ফলন স্বাভাবিকভাবেই বেশি হওয়ার কথা। কাজেই কৃষির কাঠামোগত রূপান্তরটি হতে হবে খামারের গড় আয়তন বর্ধনমুখী।
এই যে খণ্ড খণ্ড জমিতে নতুন ধরনের কৃষকের আবির্ভাব, তাদের কার্যক্রম কৃষি অর্থনীতিতে কী ধরনের পরিবর্তন আনছে?
এম এ সাত্তার মণ্ডল: আমি এই ক্ষুদ্র খণ্ডকালীন কৃষকদের ‘নব্য কৃষক’ বলছি। অতীতে যারা ক্ষেতমজুর ছিলেন, তারাই এখন নতুন প্রযুক্তির সহায়তায় কৃষক হয়ে উঠছেন। ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলারের মতো যন্ত্র আসায় কায়িক শ্রমের চাহিদা কমেছে, যা তাদের জন্য সুযোগ তৈরি করেছে। তারা এখন উচ্চমূল্যের ফসল—যেমন শাকসবজি ও ফল চাষে ঝুঁকছেন। তবে তাদের মূল সমস্যা হলো জমিগুলো একাধিক খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত থাকা, যা সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনাকে কঠিন করে তোলে।
মালিকানাভিত্তিক ভূমি সংস্কারের চেয়ে ‘ব্যবহারিক বা ব্যবস্থাপনাগত একত্রীকরণ’ এখন বেশি বাস্তবসম্মত বলে মনে করছেন?
এম এ সাত্তার মণ্ডল: ঠিক তাই। খামারের ক্ষুদ্র আয়তন ও কৃষিজমির খণ্ড-বিখণ্ড হওয়া আমাদের সবচেয়ে বড় কাঠামোগত দুর্বলতা। এর সমাধান গতানুগতিক ভূমি সংস্কারে নেই। সমাধান লুকিয়ে আছে ‘ব্যবস্থাপনাগত একত্রীকরণে’। যেমন, একজন
শ্যালো টিউবওয়েল মালিক নিজের ছোট জমি ছাড়াও আশপাশের ১০ থেকে ১৫ বিঘা জমিতে সেচ সেবা দিয়ে একটি ‘কমান্ড এরিয়া’ তৈরি করছেন। এখানে জমির মালিকানা বদলাচ্ছে না; কিন্তু উৎপাদনের প্রয়োজনে জমিগুলো একটি ব্যবস্থাপনার আওতায় আসছে। পাওয়ার টিলার, কম্বাইন হারভেস্টার—সব ক্ষেত্রেই এ মডেল কাজ করছে। এই বাজারভিত্তিক মডেল, যেখানে জমি লিজ বা বন্ধকির মাধ্যমে খামারের কার্যকর আয়তন বৃদ্ধি করা যায়, সেটিকেই আমাদের নীতিগতভাবে সমর্থন দিতে হবে।
কৃষি ভর্তুকি, ন্যায্যমূল্য ও বাজার নিয়ন্ত্রণ—এই তিনটির মধ্যে ভারসাম্য কীভাবে আনা যায়?
এম এ সাত্তার মণ্ডল: ভারসাম্য আনা বেশ কঠিন, কারণ আমাদের উৎপাদক ও ভোক্তার অবস্থান ভিন্ন। দেশের ১৪ কোটি মানুষ গ্রামাঞ্চলে, যারা একাধারে উৎপাদক ও ভোক্তা। তাদের মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য থাকলেও মূল সংকট তৈরি হয় শহরের ৪ কোটি ভোক্তার জন্য। যখনই সরবরাহ ব্যবস্থায় সামান্য বিঘ্ন ঘটে, তখনই শহুরে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। মোদ্দা কথা, খামারের গড় আয়তন বৃদ্ধি পেলে তাদের মোট উৎপাদনের পরিমাণ বাড়বে, কৃষকের সংখ্যা কমবে এবং সেইসঙ্গে তাদের বাজারে দরকষাকষির সক্ষমতাও বাড়বে।
অনেক সময় দেখা যায়, কোনো এক বছর আলুর দাম বাড়লে পরের বছর এত বেশি আলু উৎপাদিত হয় যে কৃষক দামই পান না। এ অসামঞ্জস্য দূর করার উপায় কী?
এম এ সাত্তার মণ্ডল: এ সমস্যাটি নতুন নয়, অর্থনীতিতে একে ‘কবওয়েব থিওরেম’ বলা হয়। কৃষক গত বছরের দাম দেখে পরের বছরের উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেন। এর সমাধান হলো উন্নত ‘ফোরকাস্টিং সিস্টেম’ বা পূর্বাভাস ব্যবস্থা। আবহাওয়া, আন্তর্জাতিক বাজার এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা সম্পর্কে সঠিক তথ্য কৃষকের কাছে পৌঁছানো গেলে তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। আমাদের দেশে এ তথ্যব্যবস্থা এখনো ততটা শক্তিশালী নয়।
উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত এই দীর্ঘ শৃঙ্খলে মধ্যস্বত্বভোগীর ভূমিকা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়। এই বাজার কাঠামো কি কৃষকমুখী করা সম্ভব?
এম এ সাত্তার মণ্ডল: আমি ‘মধ্যস্বত্বভোগী’ শব্দটি ব্যবহার করতে চাই না, কারণ এটি একটি নেতিবাচক ধারণা দেয়। আমি তাদের বলি ‘মার্কেটিং এজেন্ট’ বা বিপণন প্রতিনিধি। বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশের কৃষি ব্যবস্থা ক্ষুদ্র ও খণ্ডিত হওয়ায় এই এজেন্টরা বাজারের একটি প্রয়োজনীয় অংশ। যখন একজন কৃষক মাত্র ৫ বা ১০ কেজি পণ্য উৎপাদন করেন, তখন তার পক্ষে সরাসরি ভোক্তার কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। এই এজেন্টরাই সে সংযোগটি স্থাপন করে। মজার বিষয় হলো, এদের অনেকেই নিজেরাও কৃষক, যারা বাড়তি আয়ের জন্য এ কাজ করেন।
সমস্যাটা এজেন্টদের অস্তিত্বে নয়; বরং তাদের সংখ্যার আধিক্যে। এর মূল সমাধান হলো খামারের উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানো, যাকে ইংরেজিতে বলে ‘ইকোনমিকস অব স্কেল’। যখন খামারের আকার বড় হবে এবং উৎপাদনের পরিমাণ বাড়বে, তখন অনেক এজেন্টের প্রয়োজন হবে না এবং কৃষকের দরকষাকষির ক্ষমতাও বাড়বে।
সরকার বাণিজ্যিক কৃষিকে বেশ উৎসাহ দিচ্ছে। এ ধারাটি কি ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য কোনো ঝুঁকি তৈরি করছে?
এম এ সাত্তার মণ্ডল: না, আমি মনে করি বাণিজ্যিক কৃষি কোনো ঝুঁকি নয়, বরং এটি একটি সময়ের চাহিদা এবং প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া, যার মধ্যে ঝুঁকি মোকাবিলা করার কৌশলগুলো নিহিত থাকার কথা। খোরপোশ কৃষি থেকে বেরিয়ে এসে লাভজনক কৃষিতে উত্তরণ সবার জন্যই জরুরি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বীজ বা প্রযুক্তি দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, কিন্তু তারা মূলত স্থানীয় বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমেই কাজ করে। তারা প্রযুক্তি ও পুঁজি নিয়ে আসছে, যার ফলে আমরা সারা বছর ধরে উচ্চমূল্যের শাকসবজি পাচ্ছি। হাইব্রিড জাতের কারণে উৎপাদন বাড়ছে। এটা বাস্তবতা।
ক্ষুদ্র কৃষকরাও এর থেকে লাভবান হচ্ছেন। তারাই এখন সবজি চাষে সবচেয়ে এগিয়ে, কারণ এটি শ্রমনিবিড় এবং তাদের পারিবারিক শ্রম এখানে কাজে লাগছে। আমাদের শুধু খেয়াল রাখতে হবে যে, এই বাণিজ্যিক কৃষিতে উৎপাদিত পণ্য যেন নিরাপদ হয়। কীটনাশক বা অন্যান্য উপকরণের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
এই বাণিজ্যিক কৃষিকে লাভজনক করতে প্রযুক্তির ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? বিশেষ করে যেখানে আমাদের খামারগুলো এখনো অনেক ছোট।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: কৃষিকে লাভজনক করতে হলে প্রযুক্তির কোনো বিকল্প নেই। আমরা এখন সনাতন কৃষি বা সবুজ বিপ্লবের পর্যায় পেরিয়ে ‘ডিজিটাল কৃষি’র যুগে প্রবেশ করছি। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ড্রোন। একদিকে যখন শ্রমিকের সংকট, অন্যদিকে তখন মাটির গুণাগুণ বিচার করে সঠিক পরিমাণে সার ও কীটনাশক প্রয়োগের জন্য ড্রোনের মতো প্রযুক্তি অপরিহার্য। ধরুন, কোনো ভুট্টা ক্ষেতে ‘আর্মি ফলওয়ার্ম’ পোকার আক্রমণ হলো। দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যে স্প্রে না করলে পুরো ফসল নষ্ট হয়ে যাবে। একজন ক্ষুদ্র কৃষকের পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে সেই ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন। কিন্তু একটি ড্রোন সার্ভিস থাকলে তা সহজেই সম্ভব। একইভাবে ‘ক্রপ রোবোটিক্স’ এখন আর স্বপ্ন নয়। একটি সাধারণ মোটরবাইকের দামেই এই প্রযুক্তি পাওয়া সম্ভব। একজন তরুণ উদ্যোক্তা একটি রোবট কিনে পুরো গ্রামে সেবা দিতে পারেন। কৃষককে এই প্রযুক্তিগুলোর মালিক হতে হবে না, তাকে শুধু সেবাটি কেনার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে, ঠিক যেমনটি ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলারের ক্ষেত্রে হয়েছে। আর এ প্রযুক্তিগুলোর সফল প্রয়োগের জন্যই আমাদের কৃষিশিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ আরও বাড়াতে হবে।
কৃষি খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও তাদের আইনি স্বীকৃতি বা ন্যায্য মজুরি এখনো নিশ্চিত হয়নি। এই বৈষম্য দূর করতে কী করা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
এম এ সাত্তার মণ্ডল: কৃষিতে নারীদের মজুরি বৈষম্য অবশ্যই আছে। তবে এর কারণ আইনি কাঠামোর চেয়েও বেশি সামাজিক। গ্রামীণ সংস্কৃতিতে নারীদের শ্রমকে এখনো পুরুষের সমান মর্যাদা দেওয়া হয় না। তবে আমি মনে করি, শিক্ষা এবং সচেতনতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। এখন নারীরা নিড়ানি দেওয়া থেকে শুরু করে ফসলের পরাগায়নের মতো জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোও করছেন, যা পুরুষরা ভালো পারেন না। তাদের এ অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা জরুরি। আমার ধারণা, আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে এ বৈষম্য অনেকটাই কমে আসবে।
ইদানীং শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে ফলমূল, গরু বা মাছের খামারের মতো বাণিজ্যিক কৃষিতে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এ ধারাটিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
এম এ সাত্তার মণ্ডল: আমি এটিকে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে দেখি। এই শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তারাই আমাদের কৃষির ভবিষ্যৎ। তারা উচ্চমূল্যের কৃষিতে, যেমন—আম, পেয়ারা, কলার বাগান বা হাঁস-মুরগি, দুধ ও মাছের খামারে বিনিয়োগ করছে। তবে তাদের একটি বড় অংশ এখনো ধান বা প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদনে আসছে না, কারণ সেখানে ঝুঁকি এবং বিনিয়োগের ধরন ভিন্ন। যদি খামারের আয়তন ‘ব্যবস্থাপনাগত একত্রীকরণের’ মাধ্যমে বাড়ানো যায়, তবে এই তরুণরা হাই-টেক প্রযুক্তি নিয়ে ধান উৎপাদনেও আসবে বলে আমার বিশ্বাস। এরই মধ্যে ধান গমের বীজ উৎপাদনে শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছে। তখন আমাদের ‘ইল্ড গ্যাপ’ বা ফলনের পার্থক্য কমে আসবে এবং খাদ্য নিরাপত্তা আরও শক্তিশালী হবে।
২০৫০ সালে দেশের জনসংখ্যা যখন আরও বাড়বে, তখন খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি জমির সুরক্ষার জন্য কোন তিনটি এখনকার করণীয়কে আপনি অগ্রগণ্য মনে করছেন?
এম এ সাত্তার মণ্ডল: প্রথমত, আমাদের যে কোনো মূল্যে ফলন বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের কৃষি জমিতে শিল্পায়ন বা নগরায়ণ হবেই—এটা আটকানো কঠিন। তাই কম জমিতে বেশি ফসল ফলানোই একমাত্র পথ।
দ্বিতীয়ত, খামারের ব্যবহারিক আয়তন বাড়ানো। আমি যে ‘অপারেশনাল কনসোলিডেশন’ বা ব্যবস্থাপনাগত একত্রীকরণের কথা বললাম, সেটিকে প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতিগত সমর্থন দিয়ে এগিয়ে নিতে হবে।
তৃতীয়ত, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। যদিও এটি সরাসরি কৃষির বিষয় নয়, কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধিই খাদ্য ও জমির ওপর মূল চাপ সৃষ্টি করে। এ বিষয়ে আমাদের আবারও মনোযোগ দিতে হবে।
আগামী দশকের জন্য বাংলাদেশের কৃষি দর্শন নির্ধারণ করলে তার মূলমন্ত্র কী হওয়া উচিত—উৎপাদন, প্রযুক্তি, নাকি টেকসই জীবন?
এম এ সাত্তার মণ্ডল: আমার মতে, মূল দর্শন হওয়া উচিত উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি। কারণ, আমাদের সবকিছুর মূলে রয়েছে বিপুল জনসংখ্যা এবং সীমিত জমি। এ উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর অপরিহার্য অনুষঙ্গ বা মাধ্যম হলো প্রযুক্তি। আর এই দুটি যখন একসঙ্গে কাজ করবে, তখন কৃষকের জীবনমান উন্নত হবে এবং সেটাই হবে টেকসই জীবন। সুতরাং, একটি আরেকটির পরিপূরক। তবে আমাদের যাত্রা করতে হবে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে।
মন্তব্য করুন