লুৎফর রহমান
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০২:৪২ এএম
আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০২:৫৭ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আ মরি বাংলা ভাষা

সাহিত্যের ভাষা, শিল্পের ভাষা

সাহিত্যের ভাষা, শিল্পের ভাষা

ভাষা সামাজিকভাবে উৎপন্ন যোগাযোগের মাধ্যম। মানুষের প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামে যাবতীয় যোগাযোগ ভাষার মাধ্যমেই সাধিত হয়। আজকের মানুষ কেবল নিজের সমাজই নয়, বিশ্ব সমাজের সঙ্গেও প্রতিমুহূর্তে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে মানুষের সামাজিক সম্পর্কও বিচিত্র। একেকজনের সঙ্গে আমাদের একেক ধরনের প্রয়োজনের সম্বন্ধ, যোগাযোগের ধরনও ভিন্ন ভিন্ন। প্রয়োজনবিহীন কোনো যোগাযোগ নেই। প্রয়োজন ও যোগাযোগের প্রকৃতি বা নেচার অনুযায়ী ভাষার রূপ বদলায়। অর্থাৎ ব্যবহারের ভাষাটি যদি ইংরেজি হয় তবে মালপত্র ডেলিভারি দেওয়ার পত্রের ভাষাটি হবে একরকম, উপর্যুক্ত মালপত্রের চালানের ভাষাটি হবে আরেকরকম। সচিবালয় থেকে সচিব মহোদয় জেলা সদরে ডিসি সাহেবকে যে নির্দেশনাটি পাঠাবেন, তার সঙ্গে ডিসি সাহেবের উত্তরটি হবে ভিন্নরূপ ভাষায় রচিত। দেখা যাচ্ছে, পদমর্যাদা অনুযায়ীও ব্যবহারিক ভাষার ব্যবধান চিহ্নিত।

একইভাবে, এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিক্রেতার সঙ্গে সাধারণ ক্রেতার, পাইকারের প্রয়োজনের ধরন ও যোগাযোগের ভাষা ভিন্ন ভিন্ন। দাপ্তরিক ভাষা (সরকারি দপ্তর ও বেসরকারি দপ্তরের পৃথক পৃথক ভাষা) এবং প্রতিদিনের আনুষ্ঠানিক ভাষা আলাদা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী-শিক্ষকের মধ্যে প্রচল ভাষাটি একরকম এবং ওই প্রতিষ্ঠানের অন্যদের সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভাষা ভিন্নরকম। শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভাষা ও পারিবারিক ভাষার ব্যবধানটিও খুবই স্পষ্ট। মায়ের নির্দেশ ও শিক্ষকের নির্দেশের ভাষার ব্যবধান তাদের সম্পর্কের মতোই দুই স্তরের। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কের ধরন, প্রয়োজনের ধরন অনুযায়ী মানুষ ভাষা ব্যবহার করে। সামাজিক সম্পর্কগুলো আত্মীয়, অনাত্মীয়, বন্ধু, শত্রু, ছোট, বড় এরূপ বিচিত্ররকম। এ ক্ষেত্রেও যোগাযোগের ধরন আলাদা। ভাষার প্রয়োগ সেই ধরন অনুযায়ী হয়ে থাকে। তার প্রকৃতি বা নেচারও আলাদা।

শব্দ ব্যবহারের মধ্য দিয়েও ভাষার রূপের বা ধরনের পরিবর্তন ঘটে। বক্তার উদ্দেশ্য, প্রয়োজন, মনোভাব অনুযায়ী শ্রোতা বা পাঠক রিঅ্যাক্ট বা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বা প্রকাশ করে। অতএব শব্দের অর্থ-সংকেত ভাষা ব্যবহারকারীর অনেক বড় সম্পদ। যে ব্যক্তি তার ভাষার যত অধিকসংখ্যক শব্দের অর্থ-সংকেত আয়ত্ত করেছে, সে তত বেশি কায়দা করে, কৌশলের আশ্রয় নিয়ে তার বক্তব্য প্রকাশ করতে পারবে। ভাষার জাদুশক্তি এ ব্যবহার কৌশলের মধ্য দিয়েই সৃষ্টি হয়।

ভাষায় ব্যবহৃত শব্দের যেমন রয়েছে অর্থ-সংকেত; তেমনি আছে তার ধ্বনিগুণ। এই ধ্বনিগুণের দ্বারাই বক্তা শ্রোতার চেতনায় প্রথমে সংক্রমণ সৃষ্টি করে। অর্থাৎ বক্তা অন্তরের আবেগের, ভাবের বা মনোভাবের দ্বারা শ্রোতাকে নিজের সংস্পর্শের কেন্দ্রে নিয়ে আসে বা আকৃষ্ট করে। তা কতটা আন্তরিক, কতটা আন্তরিকতাশূন্য কেবল প্রয়োজনের; আনন্দ, আদর, ভালোবাসায় পরিপূর্ণ, বিরক্তিপূর্ণ; অবহেলা, উপেক্ষা বা তুচ্ছতাচ্ছিল্যে ভরা তা প্রথমত ধ্বনি-সংকেতের সংস্পর্শে এলেই শ্রোতা বুঝে ফেলে। অতঃপর অর্থ-সংকেত শ্রোতাকে বক্তার মনের অবস্থার সঙ্গে যুক্ত করে এবং বক্তার সঙ্গে তার ওই মুহূর্তের আচরণের কায়দাটি কোন ধরনের হবে তা ঠিক করে নেয় শ্রোতা। যিনি শব্দ-ধনে ধনী নন, তিনি প্রতিদিনের জীবনে বারবার বিপাকে পড়েন। অনেক সময় শোনা যায়, এক বন্ধু অন্য বন্ধুকে বলছে—‘ওরা যখন এই কথা বলল তুই কিছুই বললি না যে?’ শ্রোতা উত্তরে বলছে—‘পরিস্থিতিটা এরকম হবে বুঝতে পারি নাই।’ বুঝতে পারাটাই যখন কাজ তখন বুঝতে না পারাটার দুটি কারণ থাকতে পারে। বুঝতে না চাওয়ার দরুন অন্যমনস্কতা, পরিস্থিতি সম্বন্ধে সচেতনতার অভাব এবং শব্দের অর্থ-সংকেত বুঝতে না পারা। কাজেই শব্দের অর্থ-সংকেতে ধনী ব্যক্তিই প্রতিযোগিতায় থাকে এগিয়ে।

একজন লেখক মূলতই ভাষার কারবারি। তার মূলধন ভাষা। ভাষার সাহায্যেই তিনি গল্প বোনেন, কবিতার ভাবের বিস্তার ঘটান, নাটকের সংলাপ সৃষ্টি করেন, উপন্যাসের উচ্চাঙ্গের মুহূর্ত সৃষ্টি করেন। সাহিত্যের মনোজ্ঞ বর্ণনা, চরিত্রের জটিল, কুটিল মনোভঙ্গি, অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি সবই ভাষার সাহায্যে সৃষ্টি করেন শিল্পী-সাহিত্যিক-কবিগণ।

মানুষ শৈশব থেকেই পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা প্রয়োজনে বিনিময়ের মাধ্যমে কিছু শব্দের অর্থ-সংকেত সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারণা অর্জন করে। তাতে প্রতিদিনের প্রয়োজন মিটে হয়তো, কোথাও কোথাও যে সমস্যা হয় না তা নয়। সমস্যা দেখা দেয় নিজের সমাজের বাইরে আরও বৃহত্তর সমাজে, প্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে। সেখানে লোকভাষা বা প্রতিদিনের কথা বলার ভাষা ছাড়াও আরেক প্রকার ভাষার প্রয়োগ রয়েছে, যে ভাষায় ব্যবহৃত শব্দের সবগুলোর অর্থ-সংকেত আমার জানা নেই। সেগুলো সংশ্লিষ্ট দাপ্তরিক ভাষা। সাধারণ কথায় তারা পরিভাষা নামে পরিচিত। সব পরিভাষা আমার জানা না থাকাই স্বাভাবিক। যা জানা নেই, তা জেনে না নিলে ওই পরিবেশে বা কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকা যায় না। অতএব কর্মজীবনে আমরা ভাষা শিক্ষার জন্য আবার আলাদা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা শুরু করি। ইংরেজি, ফারসি, আরবি, ফরাসি, জার্মানি, জাপানি, কোরিয়ান, রুশ ইত্যাদি ভাষার দক্ষতার ওপর ভর করে বাঙালি ওইসব ভাষা অধ্যুষিত দেশে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ করতে, গবেষণা ও চাকরি করতে যায়। কিন্তু শিক্ষার্থী জীবনেই সেটা সম্ভব ছিল প্রতিদিনের চর্চার মধ্য দিয়ে। অবশ্য সেটা ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনার বিষয়। তাই ভাষা শিক্ষার পরিকল্পনা শুধু কবি-সাহিত্যিককেই করতে হয় তা নয়, একালে সব শিক্ষিতের জন্য ভাষা শিক্ষার পরিকল্পনা গ্রহণ অধিকতর গুরুত্বের দাবিদার।

উত্তর-আধুনিক যুগে বাণিজ্য অর্থনীতির অবাধ প্রবাহের মুক্তবাজারে যিনি যত বেশি ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করবেন তার পক্ষে বৈশ্বিক যোগাযোগ তত সহজ হবে; তিনি ব্যবসায়ে সফলতা লাভ করবেন অনায়াসে। তথ্যপ্রযুক্তির ভাষা রপ্ত না করলে যেমন নিও-মিডিয়া ব্যবহার করতে পারব না, তেমনি যে রাষ্ট্রের সঙ্গে বিনিময় বা ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন করতে ইচ্ছুক, সে রাষ্ট্রের ভাষাটি জানা থাকলে কাজটি হবে সহজতর। ইমেইল ইংরেজি ভাষায় পাঠালে কায়ক্লেশে উত্তর দেওয়া সম্ভব কিন্তু ‘ভিডিও কল’ জপানি, চৈনিক, ইতালিয়ান ভাষায় করা হলে অসহায় আত্মসমর্পণ করা ছাড়া গতি নেই। আজকের পৃথিবীতে ভাষার পরিধি বহুধা বিস্তৃত। সাধারণ মানুষের জীবনে যদি ভাষা শিক্ষা এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয় তবে সাহিত্যিক বা ভাষাশিল্পীর জন্য তা অপরিহার্যভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। তাকে নির্ভুল ভাষা ব্যবহারবিধি আয়ত্ত করতে হবে। তার ভাষাকে ব্যাকরণসিদ্ধভাবে, সুষমামণ্ডিত, শ্রুতিসুন্দর করে ও অর্থবোধকভাবের বাহক করে তুলতে হবে।

অভিধান যে কোনো ভাষার শব্দার্থ-সংকেতের ভান্ডার। অভিধানচর্চা তাই প্রত্যেক ভাষাভাষীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। অভিধান শুধু শব্দটির একটি অর্থই জানাবে না। শব্দটি আর কোন কোন অর্থে ব্যহৃত হয় তাও বলে দেবে; শব্দটি কীভাবে কোন ভাষা থেকে কী কী পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমার কালে এসে পৌঁছেছে তাও বলে দেবে। অভিধানই বলে দেয় যে, যুগে যুগে মানুষের প্রয়োজন ও যোগাযোগের মধ্য দিয়ে ব্যবহারে শব্দটির আদি রূপেরও পরিবর্তন ঘটে, অর্থেরও পরিবর্তন ঘটে অনেক ক্ষেত্রে। যে শব্দটি নির্বাচন করেছি তা—বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম, ক্রিয়া, ক্রিয়া বিশেষণ, অব্যয় ইত্যাদি যেমন বলে দেয়, তেমনি বলে দেয়—ওই বিশেষ শব্দটির ধাতুরূপটি, সমাসজাত শব্দ, সন্ধিজাত শব্দ, দেশি, বিদেশি শব্দ, তৎসম শব্দ, না খাঁটি বাংলা অর্থাৎ শব্দটির জাতপরিচয়-বিষয়ক বিস্তারিত তথ্য একটা উৎকৃষ্ট অভিধানে পাওয়া যায়। বিদেশি ভাষার অভিধান থেকে বিদেশি শব্দ, আঞ্চলিক ভাষার অভিধান থেকে আঞ্চলিক ভাষার শব্দ, পারিভাষিক অভিধান থেকে পারিভাষিক শব্দ, বানান অভিধান থেকে শব্দের বানান, বিবর্তনমূলক অভিধান থেকে শব্দের বিবর্তন বিষয়ে অবহিত হওয়া যায়। ইচ্ছুক ব্যক্তি চাইলেই নিজ চেষ্টায় একজন শ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ বা ভাষা ব্যবহারকারী হতে পারেন। উল্লেখ্য, সৎসাহিত্যিক আজীবন নিষ্ঠাবান ভাষাচর্চাকারী। সাহিত্যিক শুধু ভাষা ব্যবহারকারীই নয়, ভাষা স্রষ্টাও। প্রত্যেক যুগস্রষ্টা লেখক একেকটা ভাষারীতির স্রষ্টা, নিজস্ব ভাষারীতির জন্য তিনি বিস্তর নতুন নতুন শব্দ, রূপক, প্রতীক, উপমা সৃষ্টি করেন। আঞ্চলিক ভাষার শব্দ থেকে চমৎকার শ্রুতিসুন্দর, অনিন্দ্য অর্থবোধক শব্দ তিনি তার ভাষারীতিতে যোগ করেন। এভাবে মৌলিক শিল্পী নিজ মাতৃভাষার উন্নয়নে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেন।

চারপাশের জীবন ও প্রকৃতি শিল্পীকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। ভাবাবেগ আচ্ছন্ন শিল্পী পরিবেশের সঙ্গে সর্বভাবে একাত্ম হতে চান। পরিবেশের ভাষা তিনি অনায়াসে বোঝেন—বোঝেন তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। পরিস্থিতির ভাষা বুঝে তিনি তার করণীয় ঠিক করেন। এটাও এখন তিনি জানেন, সমাজের প্রত্যেক মানুষের কথা বলার একটা আলাদা ভঙ্গি বা ধরন আছে। সেই ভঙ্গিগুলো কিছু আঞ্চলিক, কিছু পেশাগত (গার্মেন্টস ফেকট্রি, ব্যাংক, চিকিৎসা বা কৃষি, শিক্ষা), বৈষয়িক ইত্যাদি। মানুষকে এখন তিনি পেশাগত ভাষা দ্বারা শনাক্ত করেন। একজন ব্যাংক কর্মকর্তা, একজন কৃষক, একজন বিদ্যার্থী, একজন পুলিশ, একজন ব্যবসায়ী, একজন সামরিক বাহিনীর সদস্য, একজন পুরোহিত, একজন শিক্ষককে তিনি তাদের কর্মক্ষেত্রে ব্যবহৃত ভাষা থেকেই, ভাষা দ্বারাই পৃথক করেন। চরিত্র তো লেখকের সৃষ্টি, সমাজের নানান পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ প্রথমত। তাই শিক্ষা, পেশা, সামাজিক স্তর ও বয়স অনুযায়ী হবে তার ব্যবহৃত ভাষা—লেখককে উল্লিখিত সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ভাষা ও মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। অন্যথায় চরিত্র সৃজন যেমন হবে না যথাযথ, তেমনি হবে না তাদের ভাষার সার্থক প্রয়োগও। সৃজনশীল লেখক বা শিল্পীর সামগ্রিক প্রস্তুতির অংশ হলো তার ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তুতি। সামাজিক মানুষ যাদের একজন শিল্পী, চরিত্র হিসেবে নির্বাচন করেছেন তাদের ভাষার সঙ্গে শিল্পীর নিজস্ব উপস্থাপনার ভাষা আলাদা হওয়া চাই। মনে রাখতে হবে শিল্পীর ভাষা শিল্পের ভাষা নয়, সেটি শিল্পীর উপস্থাপনার ভাষা। চরিত্রধর্মে এ ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। সেটিও রচনার বিষয়, পরিবেশ, পরিস্থিতি, চরিত্রের সামাজিক অবস্থান রুচি সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে। ধীরস্থির, গতিশীল, চটুল, গুরুগম্ভীর, অগভীর অর্থের, কখনো গভীরতল ছুঁয়ে যায় এমন শব্দ দ্বারা লেখক তার ভাষারীতি সযত্নে সাজান। অর্থাৎ সাহিত্যিকের হাতিয়ার ভাষা, ভাষার প্রাণ তার শব্দরাজি।

এমনিভাবে পৃথিবীর তাবৎ বস্তুর মতো সব শিল্পেরই রয়েছে নিজস্ব ভাষা। শিল্পে স্বভাব অনুযায়ী সে ভাষা গড়ে ওঠে শিল্পীর চৈতন্যে। কাজেই শিল্পীর মাতৃভাষা তো উত্তমরূপে আয়ত্ত করতে হয়ই, তার সঙ্গে আয়ত্ত করতে হয় নিজের আত্মপ্রকাশের ভাষা। সেইসঙ্গে প্রত্যেক শাখার শিল্পের নিজস্ব ভাষারীতিও। যে ভাষায় গান হয়, কবিতা হয়, সে ভাষায় প্রবন্ধ, উপন্যাস লেখা যায় না। আমরা যারা ভবিষ্যতে শিল্প সৃষ্টি করব এবং মূল্যায়ন বা বিচার করব তাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে শিল্পভাষা আয়ত্ত করতে না পারলে তা সম্ভব নয়।

শিল্পসৃষ্টির প্রযুক্তি, প্রকৌশল রপ্ত করার সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত আন্তরিকতা ও সতর্কতায় শিল্পভাষাটিও আয়ত্ত করতে হবে। অতি অবশ্যই মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞানের ভাষা ইতিহাসের ভাষা নয়, নয় রসায়নের ভাষা, পদার্থবিজ্ঞানের ভাষা এবং হিসাববিজ্ঞানের ভাষা আলাদা, আলাদা তথ্যপ্রযুক্তির ভাষা ও কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ভাষা। ভাষা স্বতন্ত্র অস্তিত্ব। প্রত্যেক শাখার জ্ঞানচর্চা নিজ নিজ ভাষায়ই করতে হয়। জ্ঞানের এক শাখার সঙ্গে অন্য শাখার যতটুকু সম্পর্ক ঠিক ততটুকুই ওই শাখার ভাষা কাজে লাগে, অন্যত্র পদার্থবিজ্ঞানের ভাষা রসায়ন শাস্ত্রের ভাষা থেকে পৃথক। জ্যামিতির শাস্ত্রীয় ভাষা তার নিজস্ব ভাষা।

ভাস্কর্যের ভাষা, চিত্রকলায় ব্যবহার করা চলে না। ক্রাফটের ভাষা চিত্রকলা থেকে কতই না তফাত। সমাজবিজ্ঞানের ভাষা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট বিষয়াবলির দ্বারা নির্ধারিত ভাষা। পারিবারিক, সামাজিক প্রথাগত বিভিন্ন সমস্যা সমাজবিজ্ঞান সমাধা করে, সে কারণেই সমাজের বিচিত্র ক্রিয়াকর্মের, চিহ্নিত সমস্যার ভেতর থেকেই সমাজবিজ্ঞানের ভাষা, পরিভাষা গড়ে ওঠে। নৃবিজ্ঞানের সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্পর্ক রয়েছে—তার অর্থ বিজ্ঞানের ভাষা দ্বারা নৃবিজ্ঞান চর্চা করা সম্ভব নয়। নৃবিজ্ঞানের গবেষণায় তার নিজস্ব ভাষা, পরিভাষাই ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

এতক্ষণকার আলোচনা দ্বারা এ সত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস ছিল যে, শিল্পসৃষ্টির ভাষা, শিল্পবিচারের ভাষা আলাদা। একইভাবে শিল্পীর দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত ভাষা ও তারই শিল্পসৃষ্টির ভাষা পৃথক অস্তিত্বসম্পন্ন। সংলাপ সৃষ্টির ভাষা এবং কোনো শিল্পসমুন্নত বর্ণনার ভাষা ভিন্ন স্বভাবের। নতুন বা নবিশ শিল্পীকে এতদবিষয়ে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে। শুধু এটুকু জেনে নিশ্চিন্তে বসে থাকলে চলবে না, নিয়মিত চর্চার ও ভাষা দিয়ে খেলার মধ্য দিয়ে নানান কৌশল আয়ত্ত করতে হবে। ভাষা যেমন ভাব, বক্তব্য, আবেগ প্রকাশের শক্তি জোগায়, তেমনি রচয়িতা বা স্রষ্টার সৃষ্টিশীল ক্ষমতারও সে স্বাক্ষর রাখে। শিল্পীর ভাষা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্যটি নবীন শিল্পী-সাহিত্যিকের জন্যই অবশ্য স্মর্তব্য।

তিনি বলেছেন—

[..] [..] [..] প্রকাশের মাধ্যম নিঃসন্দেহে ছিল আমার মাতৃভাষা। কিন্তু যে-ভাষা মানুষের, তাকে পালটে নিতে হয়েছিল ব্যক্তি হিসেবে আমার আকাঙ্ক্ষা-অনুযায়ী। গোঁড়া সম্ভ্রান্ততার কোনো দোকান থেকে কোনো কবিরই তাঁর প্রকাশমাধ্যমটি ধার করা উচিত নয়। তাঁর শুধু নিজস্ব বীজ থাকলে হবে না, নিজের জমিও তাঁকে তৈরি করতে হবে। প্রত্যেক কবির নিজস্ব-বিশিষ্ট ভাষামাধ্যম থাকে—এ কারণে নয় যে, সম্পূর্ণ ভাষাটি তাঁর নিজের তৈরি, বরং তা এ কারণে যে, তাঁর ব্যক্তিক ব্যবহার, জীবনের নিজস্ব ছোঁয়া নিয়ে, একে তাঁর নিজস্ব সৃষ্টির বিশিষ্ট বাহনে পরিণত করে। [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : একজন শিল্পীর ধর্ম, শামসুজ্জামান খান সম্পাদিত, মাসিক উত্তরাধিকার নবপর্যায়ের ৫৫তম সংখ্যা, মাঘ, ১৪২০, ১১]

প্রত্যেক ভাষাশিল্পী সাহিত্যিককে তাই করতে হয়। ভাষা ব্যক্তিত্বের স্মারক, তাই শিল্পের ভাষা কখনো প্রাত্যহিক জীবনে কথোপকথনের ভাষা হতে পারে না। প্রচলিত ভাষারীতিকে ভেঙে নিজস্ব রুচি, সৌন্দর্যবোধ ও ভাব প্রকাশের উপযোগী করে নিতে হয়। অপরের চিন্তন, মনন, দৃষ্টিকোণ যেমন আমার নয়, তেমনি অন্যের ভাষারীতি আমার প্রয়োজনের উপযোগী হতে পারে না। রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃত বক্তব্যটি একজন তরুণ লেখকের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বীজ থাকলেই যেমন চাষাবাদ করা যায় না, ক্ষেতের প্রয়োজন হয় বীজ বপনের জন্য, তেমনি ভাবনা হলো বীজ—তা বপনের জন্য নিজস্ব জমিরূপ ভাষারীতি থাকা চাই। অন্যথায় অন্যের জমিতে নিজস্ব বীজের ফসল বর্গাচাষির উৎপন্ন, জমির মালিককেও তার ভাগ দেওয়া চাই। সাহিত্যের ক্ষেত্রে তা অসম্ভব বলেই বীজ ও জমি উভয়ের মালিক হয়ে তবেই সাহিত্য সৃষ্টি করতে হয়।

লেখক: শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শিমুল বিশ্বাসের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিলেন মনোয়ারুল কাদির বিটু

বন্ধুকে বাড়িতে এনে খাওয়ায় নাজমুল, এরপর কুপিয়ে হত্যা

সিনেমার নায়ক থেকে জনতার নায়ক: থালাপতি বিজয়ের রাজনীতিতে অভিষেক

মেনস্ এশিয়া কাপের জন্য বাংলাদেশের জার্সি উন্মোচন

পর্যটক পরিচয়ে রুম বুকিং, অতঃপর...

আকিজ বশির গ্রুপে নিয়োগ, দ্রুত আবেদন করুন

চট্টগ্রামের সৈকত বার ও রেস্তোরাঁয় আগুন

ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলা ইয়েমেনে, নিহত ৬

শুটিং সেটে মারা গেলেন নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয় সিরিজের পরিচালক

কবে হচ্ছে ২০২৯ ক্লাব বিশ্বকাপ, জানিয়ে দিল ফিফা

১০

ফাইনালে মেসি-রোনালদোর রেকর্ড: সংখ্যায় কে সেরা?

১১

কক্সবাজারে পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা

১২

অক্টোবরের মধ্যে বাংলাদেশ-পাকিস্তান ফ্লাইট চালুর আশা

১৩

পদ্মা ব্যাংকের ১২৯তম পর্ষদ সভা অনুষ্ঠিত

১৪

নতুন ভূমিকায় এবার দেখা মিলবে সৌরভ গাঙ্গুলির

১৫

কেমন থাকবে আজকের ঢাকার আবহাওয়া

১৬

বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করল যুক্তরাষ্ট্র

১৭

পিকআপ চাপায় ইজিবাইকের ৩ যাত্রী নিহত

১৮

বিপাকে পড়েছেন শ্রদ্ধা কাপুর

১৯

বিয়ের আগে মা হওয়া নিয়ে গর্ববোধ করেন নেহা ধুপিয়া

২০
X