অ্যাকশন দেখতে কে না ভালোবাসেন! কুংফু-কারাতে, নিনজা টেকনিক, হৃদয় হিম করা ভিউজুয়াল এফেক্ট—সব যদি একসঙ্গে পর্দায় দেখা যায়, আর কী লাগে! অ্যাকশন সিনেমার সব রোমাঞ্চের দেখা মেলে চীনা সিনেমায়। অ্যাকশন জগতে নিজস্ব স্টাইল আর স্বতন্ত্র ভূমিকা বজায় রেখেছে ব্রুস লি, জ্যাকি চেন, জেট লিদের এই চীনা ইন্ডাস্ট্রি। সৃজনশীলতা ও ধুমধাড়াক্কা অ্যাকশনে দর্শকদের মুগ্ধ করে রাখে চীনা মুভিগুলো। হংকং ও তাইওয়ানকে নিয়ে যৌথভাবে সিনেমা বানিয়ে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তায় হলিউডের সঙ্গে প্রতিনিয়ত পাল্লা দিচ্ছে। চায়না অ্যাকশনে সিনেপ্রেমীদের একটি আলাদা প্রভাব লক্ষণীয়। কম-বেশি সবাই এসব সিনেমা পছন্দ করেন। কল্পনা আর স্বপ্নের জগতের কাহিনি তো মানুষ পছন্দ করবেই—এটাই নিয়ম। চায়নিজ সিনেমার পাঁচ কিংবদন্তিকে নিয়েই এবারের আয়োজন।
ব্রুস লি
ব্রুস লি—পশ্চিমা বিশ্বে চীনা সংস্কৃতির ধারণা আমূল বদলে দেন। বিশ্বব্যাপী সনাতনী মার্শাল আর্টকে জনপ্রিয় করে তুলতে আর অ্যাকশন সিনেমায় এক নতুন ধারা সৃষ্টি করতে তার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। ক্ষণজন্মা এই অভিনেতা খুব অল্প সময়ে বিশ্বব্যাপী এতটাই জনপ্রিয় হন যে, আজও মার্শাল আর্টের প্রসঙ্গ উঠলে ‘ব্রুস লি’ নামটি মুখে আসতে বাধ্য। সানফ্রান্সিসকোয় জন্ম নেওয়া ব্রুস লি হংকংয়েই বড় হন। হলিউডে পর্যাপ্ত সুযোগ না পেয়ে হতাশ ব্রুস লি ১৯৭১ সালে হংকংয়ে আসেন। কুংফু, ফেন্সিং, বক্সিং ও দর্শনের মিশ্রণে তিনি ‘জিত কুনে ডো’ নামে মার্শাল আর্টের নিজস্ব কৌশল উদ্ভাবন করেন। ওই সময় ‘দ্য বিগ বস’ ও ‘জিং উ মেন’ দিয়ে তিনি সিনেমা অঙ্গনে প্রভাব বিস্তার করেন। এরপর ‘রিটার্ন অব দ্য ড্রাগন’, ‘দ্য ওয়ে অব দ্য ড্রাগনে’র পর বিশ্ব কাঁপানো সিনেমা ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ তাকে বিশ্ব সিনেমায় জীবন্ত কিংবদন্তিতে পরিণত করে। ১৯৭৩ সালে মার্শাল আর্ট কিংবদন্তির আকস্মিক মৃত্যুতে পুরো বিশ্বেই শোক নেমে আসে।
জ্যাকি চ্যান
জ্যাকি চ্যান শুধু চীনা ইন্ডাস্ট্রি নন, জনপ্রিয় পুরো বিশ্বেই। সিরিয়াস অ্যাকশনের মধ্যেও কমেডি অভিনয় তাকে করে তুলেছে স্বতন্ত্র। এতে হাই-অ্যাকশনের একঘেয়েমি দূর করে নিয়ে এসেছে নতুনত্ব। জ্যাকি মূলত হংকংয়ের অভিনেতা ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। অ্যাক্রোবেটিক ফাইটিং স্টাইল, কমিক টাইমিং, স্ল্যাপস্টিক এবং উদ্ভাবনী স্টান্ট দিয়ে আলাদাভাবে দর্শকহৃদয়ে জায়গা করে নেন তিনি। বেশিরভাগ কঠিন স্ট্যান্ট দৃশ্য নিজেই করেন। বেশ কয়েকবার গুরুতর আহত হওয়ার পরও তিনি থামেননি। অ্যাকশন কমেডি ‘স্নেক ইন দ্য ঈগলস শ্যাডো’ দিয়ে ১৯৭৮ সালে তার সফল পথচলার শুরু। এর ধারাবাহিকতায় আশির দশকে ‘হুইলস অন মিলস’ ও ‘পুলিশ স্টোরি’ তাকে নিয়ে যায় সাফল্যের চূড়ায়। নব্বইয়ের দিকে ‘রাম্বল ইন দ্য ব্রঙ্কস’ ও পুলিশ অ্যাকশন কমেডি ছবি ‘রাশ আওয়ার’ দিয়ে হলিউড অঙ্গনও নিজের করে নেন। প্রায় ৬০ বছরের ক্যারিয়ারে এখনো জ্যাকি চ্যান পর্দা মাতিয়ে যাচ্ছেন।
জেট লি
১৯৮২ সালে ‘শাওলিন সি’ সিনেমায় এক যুবকের আবির্ভাব। মার্শাল আর্টের কিংবদন্তি চরিত্রের সেই যুবক পরে চীনা সিনেমায় রাজত্ব করেন দীর্ঘ সময়, আর নিজেকে নিয়ে যান জনপ্রিয়তার চূড়ায়। তিনি চীনা চলচ্চিত্রের প্রাণপুরুষ লি লিয়াঞ্জি, তবে সবাই তাকে চেনেন জেট লি নামে। মার্শাল আর্টের ওপর অসাধারণ দক্ষতা সদাচারী ও নম্র নায়কদের অন্যতম জেট লি চীনের মার্শাল আর্টকে সিনেপর্দায় পুনরুজ্জীবিত করতে ভূমিকা রাখেন। ‘ওয়ানস আপন আ টাইম ইন চায়না’, ‘বর্ন টু ডিফেন্স’, ‘লং জিং তিয়ানজিয়া’, ‘দ্য লেজেন্ড অব দ্য সোর্ডসম্যান’-এ তার হাড় হিম করা মার্শাল আর্টের প্রদর্শনী দেখা যায়। জেট লি হলিউডের বিখ্যাত সিনেমা ‘লেথাল উইপন’-এ খলচরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেন। তার সর্বশেষ সিনেমা ২০২০ সালে ‘মুলান’, যেখানে তিনি চীনের সম্রাটের অভিনয় করেন।
নোরা মিয়াও
কুংফু-কারাতে, মার্শাল আর্টকে বড় পর্দায় জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে শুধু পুরুষ মাসলম্যানরাই নন, অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন বেশ কয়েকজন অভিনেত্রী। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ও শক্ত ভূমিকা রেখেছেন নোরা মিয়াও। সত্তরের দশকে পর্দা কাঁপানো এই অভিনেত্রী মার্শাল আর্ট কিংবদন্তি ব্রুস লির সঙ্গে হংকংয়ের তিনটি সিনেমায় পর্দা ভাগ করেছেন। জনপ্রিয় চীনা সিনেমা ‘নিউ ফিস্ট অব ফিউরি’তে জ্যাকি চ্যানের সঙ্গে তার রসায়ন সিনেপ্রেমীদের কাছে আজীবন স্মৃতি হয়েই থাকবে। অসাধারণ সুন্দরী এই অভিনেত্রী শুধু অ্যাকশন সিনেমাই নয়, বেশকিছু রোমান্টিক ও থ্রিলারে অভিনয় করেছেন, যা তাকে চলচ্চিত্রের কিংবদন্তির কাতারেই পৌঁছে দেয়। আশির দশকের শেষ দিকে অভিনয় থেকে অবসর নিয়ে বর্তমানে টরন্টোতে একটি চ্যানেলে কাজ করছেন ৭২ বছর বয়সী নারী কিংবদন্তি নোরা মিয়াও।
ডনি ইয়েন
ব্রুস লির আকস্মিক জীবনাস্তের পর চীনা চলচ্চিত্রের ঝান্ডা যে কজন উঁচুতে ধরে রেখেছিলেন, ডনি ইয়েন তাদের অন্যতম। কুংফুর একটি বিশেষ কৌশল উইং চুনকে জনপ্রিয় করার অন্যতম কৃতিত্ব ডনি ইয়েনের। কুংফু, উইং চুনের পাশাপাশি অ্যাকশন কোরিওগ্রাফিতে মিশ্র মার্শাল আর্ট উপাদান অন্তর্ভুক্ত করে এক ব্যতিক্রমী আবহ তৈরি করতে পেরেছিলেন ডনি। এজন্যই চীনা চলচ্চিত্রে তাকে অনন্য করে তুলেছে। ‘আইপিম্যান’ সিনেমার মূল চরিত্রটি ডনি ইয়েনকে গোল্ডেন হর্স অ্যাওয়ার্ড ও হংকং ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড এনে দেয়। বিখ্যাত অভিনেতা জ্যাকি চ্যান, জেট লি, মাইকেল ইয়েওসহ অনেক বিখ্যাত অভিনেতার সঙ্গে অভিনয় করেছেন তিনি। মার্শাল আর্ট ভুবনে ডনি ইয়েন এক উজ্জ্বল নাম।
মন্তব্য করুন