এনবিআরকে বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুই ভাগ করার অধ্যাদেশে পরামর্শক কমিটির সুপারিশ ঠিকঠাক প্রতিফলিত হয়নি বলে মনে করেন ফরিদ উদ্দিন। তিনি বলেন, অধ্যাদেশটি বাতিলের দাবিতে এনবিআর কর্মীরা আন্দোলনে নামার ফলে এখন যদি ‘বিদ্বেষ’ থেকে সংস্থাটিকে দুই ভাগ করা হয়, তাহলে তা জাতির জন্য ‘ভয়ংকর’ পরিস্থিতি তৈরি করবে।
শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) ঢাকার গুলশানে এনবিআর সংস্কার বিষয়ক গোলটেবিলে তিনি এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন।মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ও পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশ (পিইবি) এ বৈঠক আয়োজন করে।
এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে ভাগ করার বিষয়টা এখানে (সংস্কার প্রতিবেদন) আমরা এনেছি। আমরা কমিটি থেকে যে সুপারিশ করেছি, আসলে সেভাবে বিষয়টা, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সেভাবে হয় নাই। আমি কিন্তু সরকারকে বলেছি, আমার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, যদি ভুল হয়, এটা কোনো বিদ্বেষ থেকে বা যদি ভুল করে করা হয়, তাহলে এটা জাতির জন্য ‘ভয়ংকর’ অবস্থা, পরিস্থিতি হবে।
গত ১২ মে রাতে এনবিআর বিলুপ্ত করে ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করে সরকার। পরের দিন থেকে আন্দোলনে নামেন দেশের প্রধান রাজস্ব আহরণকারী সংস্থাটির কর্মীরা। অবস্থান, কলমবিরতিসহ কর্মবিরতির মতো টানা কর্মসূচি পালন করেন তারা। তাদের দাবি ছিল, প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ পদে প্রশাসন ক্যাডার থেকে আসা সচিবদের যেন না বসানো হয়। এর পরিবর্তে বিসিএস (কর) ও বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) ক্যাডারের অভিজ্ঞদেরকেই যেন নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের দাবির মুখে অধ্যাদেশ বাস্তবায়ন থেকে সরে আসে সরকার। তখন সরকারের তরফে সংশোধনের কথা বলা হয়। পরে এনবিআরকে বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে যে দুই ভাগ করা হচ্ছে, সেগুলোর শীর্ষ পদে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ব দেওয়ার বিধান রাখা হচ্ছে সংশোধিত অধ্যাদেশে। রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ এর সংশোধনে ১১টি পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।
পরামর্শক কমিটির কোন সুপারিশ অধ্যাদেশে রাখা হয়নি, তা নিয়ে প্রশ্ন করলে ফরিদ উদ্দিন একটি কাগজ তুলে ধরেন এবং সবাইকে পাঠাবেন বলে জানান।
সংস্কার কমিটির এ সদস্য বলেন, সরকার যে অধ্যাদেশটা দিয়েছে, তাতে কী বলা আছে, আমি এই শিটে বলেছি। আর কী হওয়া উচিত, তাও আমি কিন্তু এক পাশে দিয়েছি। এই নথিটা আপনাদের পড়া উচিত, এটা নিয়ে আলোচনা করা উচিত। কারণ এখানে যদি ভুল হয়, যদি ভুল সরকার করে বা এই দুই বিভাগের সমন্বয়টা কীভাবে হবে, এই সমন্বয় যদি ভুল হয়, তাহলে কিন্তু এখন যে অবস্থা আছে, তার চেয়ে ‘ভয়ংকর’ পরিস্থিতি হবে।
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, এখন তো একটা জায়গা আছে (এনবিআরের), কিন্তু এখন যদি ওটা একটা ব্যুরোক্র্যাসি হয়, আর এটা (এনবিআর) যদি আলাদা হয়, তাহলে পরিস্থিতি আপনাদের জন্য আরও ‘ভয়াবহ হবে’। কাজেই ভুলটা যেন না হয়, সেজন্য আমি অনুরোধ করি, আপনারা এটা পড়েন। পড়ার পর আপনাদের মতামতটা সরকারকে দেন। বিভিন্ন ফোরামে কিংবা সংবাদমাধ্যমে সবকিছু জানান।
সঠিকভাবে কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন রাজনৈতিক ‘কমিটমেন্টের ব্যাপার’ বলে মন্তব্য করেন কমিটির আরেক সদস্য এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ। তিনি বলেন, এটা রাজনৈতিক কমিটমেন্টের ব্যাপার। কারণ হচ্ছে, দেখা গেল যে পরবর্তীকালে আমরা যে সেপারেট করেছিলাম, সেটা শোনাও হয়নি। বাতিলও করা হয়নি। ওভাবেই রয়েছে। সেজন্যই ভয় হয়, শুধু আমরা রিপোর্ট দিলাম, একটা অর্ডিন্যান্স জারি হয়ে গেল… ফরিদ যেটা বারবার বলছে। দেখা গেল যে বাস্তবায়নের সময় যদি আবার ওইটা না থাকে, ‘পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট’ যদি না থাকে।
প্রতিবেদনের ওপর ব্যবসায়ীদের মতামত চেয়ে তিনি বলেন, আমরা আপনাদের সবার কথা নিয়ে একসঙ্গে সরকারকে দিয়ে দেই। অর্থাৎ পরবর্তীকালে সরকার যখন না শুনতে যাবে, আপনারা খুব বড় গলায় বলতেও পারবেন যে, সংস্কারটা দেওয়া হয়েছিল, কী করলেন? এজন্য কিন্তু আমরা এটা পার্টিসিপেটরি করার চেষ্টা করেছি। এনবিআর সংস্কার এখন যেভাবে করা হচ্ছে, তা আসলেই ব্যবসায়ী সমাজ চাচ্ছে কিনা, তা নিয়ে ‘প্রচুর বিভ্রান্তি’ রয়েছে বলেও মনে করেন কেউ কেউ।
এমসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি নিহাদ কবির বলেন, এনবিআর সংস্কার কমিটি দ্বারা চমৎকার কাজ হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখছি না যে, তাতে খুব বেশি গতি বা মনোযোগ পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিবেদনটি রয়েছে, কিন্তু আমরা জানি না সেই প্রতিবেদনের পরিণতি কী হবে। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগতে পারি না যে এই প্রতিবেদনটি বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত মনোযোগ দেওয়া হবে, যেখানে প্রচুর কঠোর পরিশ্রম করা হয়েছে। আরেকটি বিষয় আমরা দেখেছি, তা হলো, আমরা হঠাৎ করে এনবিআরকে আলাকা করা দেখেছি। আমরা দেখেছি যে, বোর্ডটি নিজেই আর থাকবে না। বর্তমান কর্মকর্তারা অর্থ মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত হবে। এটি কীভাবে কাজ করবে এবং আমরা কি আসলেই এ ধরনের সংস্কার খুঁজছি কিনা, তা নিয়ে আমাদের মনে ‘প্রচুর বিভ্রান্তি’ রয়েছে।
নিহাদ কবিরের মতো পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, সংস্কারে এ কমিটি চমৎকার ‘ইনেশিয়েটিভ’ ছিল। তারা বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার সঙ্গে আলোচনা করে সুপারিশ দিয়েছে। তবে তাদের সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকারের মধ্যে আগ্রহের অভাব দেখা যাচ্ছে। পৃথক যেভাবে করা হচ্ছে, তা সরকারের ‘রাইট ডিসিশন’ কিনা, সেই প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, এই পৃথকীকরণ ‘ইফেক্টিভ’ না হলে এখন তো এক জায়গায় ‘হ্যাসেল’ হয়, তখন দুটি আলাদা বিভাগে ‘টু স্টেপ হ্যাসেল’ হবে।
মন্তব্য করুন