নতুন মুদ্রানীতি তারল্য সংকট বাড়াবে, বিনিয়োগ কমবে এবং সেইসঙ্গে কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ফলে সরকারের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনও ব্যাহত হবে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা থেকে বেরিয়ে আসার কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে এ সীমা তুলে দেওয়া হয়নি; বরং ১ শতাংশ বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে সরকারি খাতে বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের বেশি ঋণ নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। টাকা ছাপিয়ে যদি সরকারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশি ঋণ দেয়, তাহলে তা কখনোই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হবে না।
এর আগে গত রোববার বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে অর্থ সরবরাহ কমাতে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। তুলে নেওয়া হয়েছে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সীমা। বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে সরকারি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। সেইসঙ্গে দেশে চলমান ডলার সংকট মোকাবিলায় এতদিন বাংলাদেশ ব্যাংক যে কম দরে ব্যাংকগুলোকে ডলার সরবরাহ করে আসছে, আগামী ১ জুলাই থেকে সেটা আর করবে না। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার নিতে হলে বাফেদা ও এবিবির নির্ধারিত দরেই ডলার নিতে হবে, যা গতকাল সর্বোচ্চ দর ছিল ১০৮ টাকা ৫২ পয়সা। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হচ্ছে ১০৫ টাকা দরে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ৯ শতাংশ সুদহার থেকে বেরিয়ে এসেছে। তবে সীমা তুলে দেওয়া হয়নি; বরং ১ শতাংশ বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। তিনি বলেন, আইএমএফের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নেওয়ার সময় শর্ত ছিল ব্যাংক ঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক করা হবে; কিন্তু তা করা হয়নি। তার মানে এটা নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।
গত ৬ মাসের বেসরকারি ঋণের লক্ষ্য অর্জিত হবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তাই এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কমানো হয়েছে, সেইসঙ্গে সরকারি ঋণের লক্ষ্য বাড়ানো হয়েছে জানিয়ে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশের বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হয় ব্যাংক খাতের মাধ্যমে। এই খাতের ঋণ কমানো হলে নতুন বিনিয়োগ হবে না। আর বিনিয়োগ না হলে দেশে নতুন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে না। সেইসঙ্গে ঋণের সুদহার বাড়ানোর ফলে চলমান বিনিয়োগের অগ্রগতিও স্থির হয়ে যেতে পারে। ফলে সরকার জাতীয় বাজেটে যে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, তাও অর্জন সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, সরকার এমনিতেই ব্যাংক খাত থেকে ঋণ বেশি নিচ্ছে। এবারের মুদ্রানীতিতে সেই লক্ষ্য আরও বাড়ানো হয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট আরও বাড়বে, যা বর্তমান অর্থনীতির জন্য গ্রহণযোগ্য নয়।
একই বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ঋণের সুদহারের সীমা তুলে দিয়ে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক যে পদ্ধতিতে এটা করবে সেটা পুরোপুরি বাজারভিত্তিক হবে না। কারণ বর্তমানে সরকারের বেশিরভাগ ট্রেজারি বিল বাংলাদেশ ব্যাংকই কিনে নিচ্ছে। এটা পুরোপুরি বাজারে ছাড়া হচ্ছে না। এটা করা যাবে না। এটা পুরোপুরি বাজারে ছেড়ে দিতে হবে। কেননা টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিলে মূল্যস্ফীতি কখনোই কমবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করে বাজার থেকে যে টাকা তুলে নিচ্ছে, এর ফলে বাজারে টাকা এবং ডলারের এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হচ্ছে, যা কখনোই কাম্য নয়। বর্তমানে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা টাকা দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। এতে আমদানি, রপ্তানিসহ সব খাতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ফলে টাকা ছাপানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও সংযত হতে হবে। খুব পরিমিতভাবে টাকা ছাপাতে হবে। সরকার বাজেটে যে বিশাল ব্যয়ের লক্ষ্য ঠিক করেছে, তা তো ব্যাংক মেটাতে পারবে না। ফলে বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককেই টাকা ছাপিয়ে ঋণ দিতে হবে। তাহলে মূল্যস্ফীতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ হবে—সেটাই বড় সংশয়। ফলে সরকারকে তার ব্যয় কমাতে হবে। আর তা না করে যদি সরকার আগের মতোই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে থাকে, তাহলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হবে না।
মুদ্রানীতি নিয়ে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সামীর সাত্তার বলেন, ঘোষিত মুদ্রানীতিতে ঋণের সুদহারের সীমা ৯ শতাংশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ ব্যবস্থার ফলে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের সুদের হার ডাবল ডিজিটে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যেটি বর্তমান বৈশ্বিক অস্থির অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা পরিচালনায় বেশ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। পাশাপাশি এ ধরনের উদ্যোগ বিশেষ করে কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ব্যবসা পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি করবে।
ব্যাংক থেকে সরকার অধিক মাত্রায় ঋণ গ্রহণ বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহকে সংকুচিত করবে জানিয়ে ব্যবসায়ী এ নেতা বলেন, সরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ হ্রাসের জন্য সরকারি ব্যয় কৃচ্ছ্রসাধন, সুশাসন, স্বচ্ছতা ও দক্ষতা আনয়ন এবং অগ্রাধিকারমূলক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রবণতা কমিয়ে আনতে কর আহরণের মাত্রা বাড়ানোর ওপর আরও বেশি হারে জোরারোপ করা উচিত, এতে করে ব্যাংক খাতের ওপর সরকারের নির্ভরতা অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
একই বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমানো মানেই হচ্ছে ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দিতে পারবে না। ফলে নতুন বিনিয়োগ কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, ঋণের সুদহারের সীমা তুলে নেওয়ায় সুদহার যখন বেড়ে যাবে, ব্যবসায়ীদের তহবিল ব্যয়, উৎপাদন ব্যয়সহ সব ধরনের ব্যয় বেড়ে যাবে, যা এ মুহূর্তে ব্যবসায়ীদের বড় ধরনের চাপে ফেলবে। কেননা বর্তমানে সারা বিশ্বেই নিম্নমুখী প্রবণতা চলছে। এ অবস্থায় এমনিতেই আমাদের ব্যবসা খারাপ, অর্ডার নাই, রপ্তানি আয় কমছে, অন্যদিকে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ার পরও আমরা ঠিকভাবে তা পাচ্ছি না- এমন অবস্থায় ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়লে আমাদের উৎপাদন খরচ আরও বেড়ে যাবে। অর্থাৎ নতুন মুদ্রানীতির কারণে একদিকে নতুন বিনিয়োগ কমে যাবে, ফলে কর্মসংস্থানও কমে যাবে। অন্যদিকে, যে কর্মসংস্থান আছে, সেটাকেও ধরে রাখা যাবে না। কারণ ব্যবসার খরচ বেড়ে গেলে অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।
এ অবস্থায়, দেশের স্বার্থে, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক যেন বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেয় এবং ঘোষিত মুদ্রানীতিটি পুনর্বিবেচনা করবে বলে আশা করছি।
সুদহার বাড়ানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় বলেন, ব্যাংক ঋণের ৯ শতাংশ সুদহার নির্ধারণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল। এ সীমা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তটিও রাজনৈতিক। আমাদের কৃতিত্ব আমরা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে পরিস্থিতি বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। যখন এ সীমা দেওয়া হয়েছিল, তখন ব্যাংকগুলোর সুদ ১৮ শতাংশে উঠেছিল। তখন বিদেশি ঋণের সুদহার ছিল ২ শতাংশ। এখন বিদেশি ঋণের সুদ ৯-১০ শতাংশ। আবার টাকার অবমূল্যায়নের কারণে তার খরচ আরও বেশি হয়ে যাচ্ছে।
উৎপাদন বাড়ানো ও প্রবৃদ্ধি অর্জন গভর্নর বলেন, বাজেটে সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলার বাইরে থেকে ঋণ পাবে বলে সরকার বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। আমরা আশা করছি, দেশ থেকে পোর্টফোলিও ও স্বল্পমেয়াদি যে বিনিয়োগ দেশ থেকে চলে গেছে তা আবার ফেরত আসবে। সেইসাথে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়বে। প্রবৃদ্ধি আসাটাই হচ্ছে বড় কথা, সেটা অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ থেকেও আসতে পারে আবার বাইরে থেকেও আসতে পারে। আমরা মনে করছি, দুটি দিক থেকে মিলেই এ প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে। আর আমরা যদি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের যে চলমান পুনঃঅর্থায়ন তহবিলগুলো রয়েছে, তার মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করব। এসএমই এবং কৃষি খাত যেন পর্যাপ্ত ঋণ পায়, সে বিষয়টি আমরা নিশ্চিত করব।
মন্তব্য করুন