চাকরি জীবনের তিন দশক শেষ করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) রাজস্ব বিভাগ থেকে ২০১৯ সালে অবসরে যান মোহাম্মদ হানিফ (ছদ্মনাম)। অবসরের পর গ্র্যাচুইটি ও প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে তার প্রাপ্য ছিল প্রায় ৩০ লাখ টাকা। সেই অর্থ দিয়ে মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা ও চিকিৎসার জন্য কিছু অর্থ সংরক্ষণের পরিকল্পনা ছিল তার।
কিন্তু বাস্তবতা হলো— প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা করে কিস্তিতে সেই টাকা পাচ্ছেন তিনি, যা সংসার খরচেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া নগর ভবনে গিয়ে প্রতি মাসে চেক তুলতে গিয়েও দিতে হচ্ছে ধরনা। হানিফ বলেন, ‘এই টাকা আমার অধিকার। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, যেন কারও কাছে ধার চাইছি। অফিসে অফিসে গিয়ে মিনতি করতে হয়। এটা কি প্রাপ্য সম্মান?’
শুধু হানিফই নন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অন্তত চার শতাধিক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে এমন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ এক যুগ ধরে ঘুরছেন। তাদের প্রাপ্য মোট অর্থের পরিমাণ প্রায় ৬০ কোটি টাকা। অথচ করপোরেশনের বার্ষিক বাজেট ২ হাজার কোটি টাকার বেশি এবং বর্তমানে সংস্থার ফান্ডে রয়েছে ২০০ কোটিরও বেশি টাকা।
সিটি করপোরেশন পরিচালিত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত এক শিক্ষক বলেন, ‘আমাদের গ্র্যাচুইটির টাকা আটকে আছে অডিট আপত্তির কারণে। অথচ আমরা জানি না কীসে আপত্তি। দুই বছরেও সমাধান হয়নি। চিকিৎসা, সংসার সব চলছে ধার-দেনায়।’
অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, এককালীন অর্থ না পেয়ে অনেকে গৃহনির্মাণ, মেয়ের বিয়ে, নিজের চিকিৎসা বা পরিবারের জীবিকার বিকল্প ব্যবস্থা করতে পারছেন না। এতে তাদের মধ্যে অনেকে সংকটে পড়েছেন। অনেকেই একাধিক জটিল রোগে ভুগছেন। কিন্তু প্রতি মাসের টাকায় সংসার চালানোর পর নিজের চিকিৎসার জন্য বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে পারছেন না। যাদের বাড়ি চট্টগ্রামের বাইরে তাদের অনেককেই প্রতি মাসে কিস্তির চেক নিতে এসে রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড বা মসজিদে রাত কাটাতে হচ্ছে।
অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আনুতোষিকের টাকা পরিশোধের দাবি জানিয়ে সম্প্রতি সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনকে চিঠি দিয়েছে চসিক এক্স অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের বেশ কয়েকজন সাবেক কর্মকর্তা স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘অবসর নেওয়ার পর কারও কারও ১০ থেকে ১২ বছর হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত পাওনা টাকা অপরিশোধিত রয়েছে। এমনকি অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের আনুতোষিক না পেয়ে এরই মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। আমরা অনেকেই খুবই আর্থিক সংকটে আছি। সাংসারিক খরচ, চিকিৎসা, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, বিয়ে-শাদি ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেকই কষ্টে জীবনযাপন করছেন। আপনি দায়িত্বগ্রহণের পর থেকে নগর উন্নয়ন, নাগরিক সেবা, গ্রিন ও ক্লিন সিটি গড়ার প্রত্যয়ের পাশাপাশি অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের প্রতি সদয় দৃষ্টি আমাদের বহুলাংশে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রেরণায় আবদ্ধ করেছে।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘আপনি অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আনুতোষিকের অবশিষ্ট টাকা পরিশোধ করে তাদের জীবনমান সচল ও মানসম্মত করতঃ বাধিত করলে আমরা আপনার নিকট চিরবাধিত থাকব। আর যদি পুরো টাকা একসঙ্গে দেওয়া সম্ভব না হয়, অন্ততপক্ষে প্রাপ্যের অর্ধেক টাকা একসঙ্গে এবং অবশিষ্ট টাকা যার যার শেষ বেসিক যত, তত টাকা প্রতি মাসে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পরিশোধ করলে আপনার নিকট চিরকৃতজ্ঞ থাকব।’
জানতে চাইলে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন আহমদ সাকী কালবেলাকে বলেন, ‘অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে অবসরের ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে পাওনাদি দিয়ে দেয়। কিন্তু সিটি করপোরেশনে এই টাকা পেতে একযুগের মতো সময় লাগে। তাও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আদায় করতে হয়। আমরা সম্প্রতি এ বিষয়ে মেয়রকে চিঠি দিয়েছি। মেয়র খুব আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের চিঠি গ্রহণ করেছেন, বিষয়টি দেখবেন বলে জানিয়েছেন।’
চসিকের প্রধান হিসাবরক্ষক হুমায়ুন কবির জানান, ‘চার শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রায় ৬০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের আমলে প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং গ্র্যাচুইটির তহবিলের টাকা খরচ করে ফেলা হয়েছিল, যা আর পূরণ করা সম্ভব হয়নি। তবে ধীরে ধীরে আমরা সংকট কাটিয়ে উঠছি।’
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘আমরাও চাই অবসরপ্রাপ্তদের পাওনা এককালীন পরিশোধ হোক। কিন্তু আমাদের ফান্ডে সংকট আছে। আমরা প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা অ্যাকাউন্টে দিয়ে দেওয়ার একটা নিয়ম করেছি। আমরা এই সমস্যাটা আরও ভালোভাবে সমাধানের জন্য কাজ করছি।’
মন্তব্য করুন