চট্টগ্রাম ব্যুরো
প্রকাশ : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:১৪ এএম
অনলাইন সংস্করণ

চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক যেন মৃত্যুফাঁদ

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে দুর্ঘটনা। ছবি : কালবেলা
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে দুর্ঘটনা। ছবি : কালবেলা

চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক এখন আর শুধু দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের যাতায়াতের পথ নয়; এটি প্রতিদিন মৃত্যুভয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে। কর্মস্থলে যাওয়া, চিকিৎসা নেওয়া কিংবা পর্যটন শেষে ঘরে ফেরার প্রতিটি যাত্রাই যেন অনিশ্চয়তায় ভরা।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত মাত্র আট মাসেই এই মহাসড়কে ৬৫টি দুর্ঘটনায় ৯৮ জন নিহত এবং ২৫৬ জন আহত হয়েছেন। প্রতিদিন হাজারো মানুষের চলাচলের এই ১৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি ক্রমেই একটি কাঠামোগত সড়ক সংকটে পরিণত হয়েছে, যেখানে দুর্ঘটনা আর ব্যতিক্রম নয়—নিয়মিত ঘটনা।

দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চন্দনাইশ, পটিয়া, বাঁশখালী, বান্দরবান, চকরিয়া ও কক্সবাজারসহ একাধিক জেলা ও উপজেলার মানুষ এই মহাসড়কের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই সড়কটি অপ্রশস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। অধিকাংশ অংশে মাত্র ১৮ থেকে ২২ ফুট চওড়া এই মহাসড়কে নেই কার্যকর কোনো বিভাজক। রয়েছে অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক, অপর্যাপ্ত সাইনেজ ও অস্পষ্ট রোড মার্কিং। অনেক এলাকায় রাতে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থাও নেই। ফলে সামান্য ভুলেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঘটছে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি–আগস্ট সময়ে সংঘটিত দুর্ঘটনাগুলোর বড় একটি অংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ ও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে যাওয়ার ঘটনা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, অধিকাংশ দুর্ঘটনার আগে বাস ও ট্রাকের বেপরোয়া গতি, ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং এবং উল্টো পথে চলাচলের দৃশ্য দেখা গেছে।

এই সংকট শুধু চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কেই সীমাবদ্ধ নয়। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) জানিয়েছে, ২০১৮ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪ হাজার ৪৩৯ জন। একই বছরে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে নিহতের সংখ্যা ৭ হাজার ২২১ এবং আহত ১৫ হাজার ৪৬৬ জন। ওই বছর গাড়িচাপায় নিহত হন ১ হাজার ৫৩৫ জন, মুখোমুখি সংঘর্ষে ৮৭৩ জন, উল্টো পথে চলাচলে ২৭১ জন এবং যানবাহন খাঁদে পড়ে প্রাণ হারান ১৫৪ জন।

২০২৫ সালের নভেম্বর মাসে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। এক মাসেই দেশে ৫২৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫০৭ জন নিহত এবং ৮৯৯ জন আহত হন। একই সময়ে রেলপথে ৪৪টি দুর্ঘটনায় ৪০ জন এবং নৌপথে ৭টি দুর্ঘটনায় ৬ জন নিহত হন। সব মিলিয়ে এক মাসে সড়ক, রেল ও নৌপথে ৫৭৭টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৫৫৩ জন।

নভেম্বর মাসের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির কারণ। এক মাসে ১৯৫টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হন ২০১ জন, যা মোট নিহতের প্রায় ৪১ শতাংশ। নিহতদের মধ্যে চালক, পথচারী, নারী, শিশু, শিক্ষার্থী এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যও রয়েছেন। নিহতদের তালিকায় পাঁচজন চিকিৎসক ও একজন সাংবাদিকের নামও উঠে এসেছে।

মহাসড়কে অবৈধ ও ধীরগতির যানবাহনের চলাচলও বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ভ্যান, ইজিবাইক ও অটোরিকশার নিবন্ধন নেই, নেই হেডলাইট বা রিফ্লেক্টর। আইন অনুযায়ী এসব যানবাহনের মহাসড়কে চলাচলের অনুমতি না থাকলেও বাস্তবে তা কার্যকর হচ্ছে না।

দুর্ঘটনার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে মামলা হলেও তদন্তের গতি অত্যন্ত ধীর। চালকের বিরুদ্ধে মামলা হলেও পরিবহন মালিক বা কোম্পানির দায় নির্ধারণ করা হয় না। প্রভাবশালী মালিকপক্ষের কারণে অনেক মামলা দুর্বল হয়ে পড়ে, সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহে গাফিলতি দেখা যায় এবং তদন্ত দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে থাকে। ফলে একই পরিবহন কোম্পানি বারবার ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ‘চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক মূলত দুই লেনের, যেখানে ডিভাইডার নেই। দুই পাশে গাছ ও বাঁকের কারণে দৃশ্যমানতা কম। অবৈধ থ্রি-হুইলার ও হাটবাজারের কারণে পথচারী পারাপার ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সড়ক প্রশস্তকরণ, বিভাজক স্থাপন এবং ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক সংস্কার করা গেলে দুর্ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।’

মোটরযানের গতিসীমা নির্দেশিকা–২০২৪ অনুযায়ী, প্রাইভেট কার ও বাসের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৮০ কিলোমিটার, মোটরসাইকেলের জন্য ৬০ কিলোমিটার এবং পণ্যবাহী যানবাহনের জন্য ৫০ কিলোমিটার নির্ধারণ করা হয়েছে।

পটিয়া হাইওয়ে থানার ওসি মোহাম্মদ জসীম কালবেলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কে অধিকাংশ চালক গতি ও ট্রাফিক নির্দেশনা মানেন না। বেপরোয়া গতি, ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং ও অসতর্কতার কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে। বিষয়টি নিয়ে হাইওয়ে পুলিশ নিয়মিত কাজ করছে।’

দুর্ঘটনা ও নিরাপত্তার দাবিতে গত ৩০ নভেম্বর লোহাগাড়া, সাতকানিয়া ও চকরিয়া এলাকায় মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন স্থানীয়রা। ‘চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক উন্নয়ন আন্দোলন’-এর ব্যানারে আয়োজিত কর্মসূচিতে ছয় লেন মহাসড়কের দাবিতে স্লোগান দেওয়া হয়। অবরোধের ফলে মহাসড়কের উভয় পাশে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্ঘটনা কমাতে হলে একক কোনো পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। সড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন, ফিটনেস ও রুট পারমিটে স্বচ্ছতা, চালকদের প্রশিক্ষণ ও কর্মঘণ্টা নিয়ন্ত্রণ, পরিবহন মালিকপক্ষের দায় নিশ্চিতকরণ এবং কঠোর আইন প্রয়োগ—সবকিছুর সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মধ্যরাতে ঝরল ২ প্রাণ

সীমান্তে মর্টারশেলের শব্দ, আতঙ্কে এলাকাবাসী

চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক যেন মৃত্যুফাঁদ

নৌবাহিনী থামাল মিয়ানমারে সিমেন্ট পাচার

আবাসিক হোটেল থেকে নারী পর্যটকের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

ফয়সালের জামিন বিতর্ক নিয়ে আসিফ নজরুলের স্ট্যাটাস

‘কোনো এক মিরাকেলের মধ্যে দিয়ে ফিরে আসেন ব্রাদার’

মানবপাচার মোকাবিলায় ভুক্তভোগী কেন্দ্রিক আইনজীবী গড়ে তোলার আহ্বান

লস অ্যাঞ্জেলেস কনস্যুলেটে বিজয় দিবসের আলোচনা সভা

সিলিন্ডার বিস্ফোরণে শিক্ষার্থীর মৃত্যু

১০

রিজার্ভ বেড়ে ৩২.৪৮ বিলিয়ন ডলার

১১

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত এলাকা গড়ার অঙ্গীকার শেখ আব্দুল্লাহর

১২

হাদির বিষয়ে ড. ইউনূসকে সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোন

১৩

অবশেষে ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ চক্রের সদস্য গ্রেপ্তার

১৪

দেশবাসীকে শান্ত থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

১৫

পে স্কেল নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে যে সিদ্ধান্ত নিল কমিশন

১৬

গাড়ির গ্যারেজে ঝুলছিল চালকের মরদেহ

১৭

হাদির অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন

১৮

কাউকে ভোট দেওয়া ফরজ নয়, ইমান নিয়ে মরা ফরজ : ছারছীনা পীর

১৯

ফিফা দ্য বেস্টে কাকে বেছে নিলেন মেসি?

২০
X