জাহাঙ্গীর আলম, আনোয়ারা (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৩২ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

নদীগর্ভে ৫ শতাধিক মানুষের বাস, অরক্ষিত বাঁধে যত ভয়

আনোয়ারার ঘটকূল পূর্বগহিরা এলাকায় শঙ্খ নদীর ভেতর বসবাসরত ঘরবাড়ি। ছবি : কালবেলা
আনোয়ারার ঘটকূল পূর্বগহিরা এলাকায় শঙ্খ নদীর ভেতর বসবাসরত ঘরবাড়ি। ছবি : কালবেলা

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল। সেই রাতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন আবদুল গফুর (৬৫)। রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুফানও বাড়তে শুরু করে। একসময় পানি বাড়ির উঠানে চলে আসলে বাড়ির অপরদের সঙ্গে ঘর থেকে বের হলেও কোথাও যাওয়ার উপায় না দেখে ঘরের চালায় উঠে পড়েন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই কে কোথায় গেছে আর কেউই জানেন না। পরের দিন খোঁজাখুঁজি করেও তার পরিবারের তিন সদস্যের সন্ধান মেলেনি। একই রাতে আশপাশের অন্তত শতাধিক মানুষ নিখোঁজ হলেও পরে মাত্র ২০-৩০ জনের মৃতদেহ পাওয়া যায়।

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের সেই ভয়াল স্মৃতি নিয়ে আজও ঘুরে বেড়াই চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের পূর্বগহিরা গ্রামের আবদুল গফুর, আবদুস সবুর, দিলুয়ারা বেগমসহ শতশত মানুষ। কিন্তু সেই ভয়াল রাতের ৩৩ বছর পার হলেও তাদের স্থায়ী ঠিকানা এখনো নদীর ভেতরেই। ১৯৯১ সালের পর বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় রায়পুর ইউনিয়নে একটি মাটির বেড়িবাঁধ নির্মিত হয়। তখন ইউনিয়নের পূর্বগহিরা ঘাটকূল এলাকার তিন চারটি বসতবাড়ি বেড়িবাঁধের বাইরে নদীর ভেতর রয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসের ভয়ে অনেকেই গ্রাম-বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেও চারটি বাড়ির ৮৫টি পরিবার দারিদ্র্যতার কারণে অন্য কোথাও যেতে পারেননি। এতে অন্তত ৫ শতাধিক মানুষ বেড়িবাঁধের বাইরে নদীর ভেতর ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন। তারা আক্ষেপ করে বলেন, সরকার ভূমিহীনদের হাজার হাজার ঘর দিলেও আমাদের কপালে তা জোটেনি।

নদীর ভেতর বসবাসকারী দিলুয়ারা বেগম (৬০) বলেন, ‘শেখ হাসিনা বওত মানুষরে ঘর দিয়ে, আঁরার হোয়ালত এইল্লা একখান ঘরও ন জোটে (শেখ হাসিনা অনেক মানুষকে ঘর করে দিয়েছেন, কিন্তু আমাদের কপালে একটি ঘরও জোটেনি)।’

১৯৯১ সালের পর থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আনোয়ারাবাসী এক প্রকার অরক্ষিত থাকলেও ২০১৮ সালে সরকার আনোয়ারার উপকূলীসহ ৩২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের উন্নয়নে ৫৭৭ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। কিন্তু কাজ শুরুর ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো ৫ কিলোমিটারের অধিক এলাকায় টেকসই বেড়িবাঁধ না হওয়ায় শঙ্কায় বসবাস করছেন উপকূলের অর্ধলাখ হাজার মানুষ।

উপকূলীয় এলাকাগুলো ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের বাইন্নার দীঘি, ফকির হাট, বার আউলিয়া, উত্তর গহিরা, দক্ষিণ গহিরা, মধ্যম গহিরা, পরুয়াপাড়া ফুলতলী এলাকাসহ উপকূলজুড়ে চলছে বেড়িবাঁধের ব্লকের কাজ। তবে পূর্বগহিরা ঘাটকুল ও সরেঙ্গা এলাকায় এখনো ব্লক বসানো সম্ভব হয়নি। এতে প্রায় ৫ কিলোমিটার এলাকা অরক্ষিত রয়ে গেছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, আনোয়ারার উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে ২০১৮ সালে সরকার ৩২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের উন্নয়নে ৫৭৭ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ শুরু করে। এতে রায়পুর ইউনিয়নের ১৩ কিলোমিটারের মধ্যে ৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধে ব্লক বসানো হয়। বাকি ৫ কিলোমিটার এলাকায় মাটি দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এই ৫ কিলোমিটারের মধ্যে গহিরা সাগর উপকূলে ২৭৭৫ মিটার ও সরেঙ্গা শঙ্খ নদীর ২৪০০ মিটার রয়েছে। এই ৫ কিলোমিটারের জন্য নতুন করে ৩০০ কোটি টাকার প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

স্থানীয় ঘাটকূল এলাকার বৃদ্ধ আবদুস সবুর বলেন, দীর্ঘদিনের স্বপ্ন একটি পাথরের বেড়িবাঁধের। তবে বেড়িবাঁধ নির্মাণ হলেও আমাদের বাড়িঘরের পাশে এখনো ব্লক বসানো হয়নি। তাই ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত শুনলে বাড়িঘর ছেড়ে চলে যেতে হয়।

রায়পুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিন শরীফ বলেন, ২০১৮ সালের আগে পুরো রায়পুর ইউনিয়ন অরক্ষিত ছিল, এখন সেখানে ব্লক বসানো হয়েছে। তবে পূর্বগহিরা ঘাটকূল ও সরেঙ্গা এলাকায়র কিছু অংশে মাটির কাজ হলেও টেকসই বেড়িবাঁধ হয়নি। তাই দ্রুত এসব এলাকায় ব্লক বসানো না হলে আবারো প্লাবিত হবে।

এ ছাড়া উপজেলার জুঁইদন্ডী ইউনিয়নের রব্বাত মিয়াজির বাড়ী থেকে হাজিবাজারসহ তিন কিলোমিটার বাঁধ ও ফসলি জমি তীব্র ভাঙনের মুখে রয়েছে। এতে ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি হারাচ্ছে শত শত মানুষ। বর্ষার আগে বেড়িবাঁধ সংস্কার না হলে বন্যা বৃষ্টির পানিতে প্লাবিত হবে পুরো জুঁইদন্ডী ইউনিয়ন। এমনটা ধারণা করছে স্থানীয় বাসিন্দারা।

জুঁইদন্ডী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাস্টার মো. ইদ্রিস বলেন, বর্ষার আগে ভাঙন না কোনো ব্যবস্থা না করলে পুরো ইউনিয়ন প্লাবিত হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভাগীয় উপপ্রকৌশলী (আনোয়ারার দায়িত্বপ্রাপ্ত) মিজানুল হক বলেন, রায়পুর ইউনিয়নের ৫ হাজার ১৭৫ মিটার বেড়িবাঁধে ব্লক বসানোর জন্য নতুন করে ৩৯৯ কোটি টাকার প্রকল্প সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন হয়ে আসলে ওই এলাকায় ব্লকের কাজ শুরু হবে।

উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে আনোয়ারা থেকে অন্তত ১০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বিলীন হয়ে যায় হাজার হাজার বাড়িঘর। দিনটি উপকূলের মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। এ উপলক্ষে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় প্রতি বছরের মতো এবারও ঘরে ঘরে মিলাদ মাহফিল, কোরআনখানি, স্মরণসভা ও দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরণসহ বিভিন্ন আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয়রা।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিএনপি নেতা ও তার স্ত্রীর আয়কর নথি জব্দের অনুমতি

মোটরসাইকেল চালক হত‍্যা মামলায় ৪ জনের যাবজ্জীবন

উপজেলা নির্বাচন / সিরাজগঞ্জের দুই বিএনপি নেতা বহিষ্কার

সিলেটে মশারি নিয়ে রাজপথে নগরবাসী

রাজশাহীতে গুটি আম পাড়া শুরু

রানার গ্রুপে ম্যানেজার পদে চাকরি, বছরে পাবেন ৩টি বোনাস

ডেঙ্গুতে এক দিনে ৩ জনের মৃত্যু

সাকিব-শান্তদের ডোনাল্ড লু’র শুভ কামনা

গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী

১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের ফল প্রকাশ

১০

গ্রামীণফোন-টিভিএস অটোর মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর

১১

এবার ওয়ালটন ফ্রিজ কিনে মিলিয়নিয়ার হলেন ভোলার শামীম

১২

প্রাথমিকের দ্বিতীয় ধাপের ফল প্রকাশ

১৩

‘ঘুম থেকে উঠে দেখতাম আমাদের দিকে অস্ত্র তাক করা’

১৪

কবর খুঁড়তে গিয়ে মিলল গ্রেনেড

১৫

এই বয়সে প্রেমের কথা চিন্তাও করি না

১৬

ইরানের বড় অস্ত্র চোরাচালান আটকে দিল জর্ডান

১৭

যুদ্ধশিশু হিসেবে প্রথম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন মেরিনা

১৮

নদীতে ভেসে উঠল স্কুলছাত্রের লাশ

১৯

জমি নিয়ে বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত ১

২০
X