

করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সাফল্য আজ আর কেবল আর্থিক সূচক—মুনাফা, প্রবৃদ্ধি বা বাজার দখলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা, প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এবং গ্রাহকের দ্রুত রুচিবদলের যুগে টিকে থাকতে হলে প্রয়োজন দক্ষ মানবসম্পদ, অভিযোজন ক্ষমতা এবং সর্বোপরি ভবিষ্যৎমুখী দৃষ্টিভঙ্গি। এই বাস্তবতায় করপোরেট খাতের সবচেয়ে বড়, অথচ নীরব ঝুঁকিগুলোর একটি হয়ে উঠছে—ভিশনহীন কর্মী।
ভিশনহীন কর্মী মানেই যে অদক্ষ কর্মী, তা নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রেই তারা সময়ানুবর্তী, নিয়মিত এবং প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ। সমস্যা শুরু হয় তখনই, যখন তাদের কাজের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য, শিল্পখাতের বাস্তবতা এবং ভবিষ্যৎ কৌশলের কোনো কার্যকর সংযোগ তৈরি হয় না। কাজ হয়, কিন্তু উদ্দেশ্য স্পষ্ট থাকে না; দায়িত্ব পালন হয়, কিন্তু দায়বদ্ধতা গড়ে ওঠে না।
ডেস্ককেন্দ্রিকতা ও ব্যবসায়িক চিন্তার অভাব
করপোরেট অফিসে প্রায়ই দেখা যায়, কর্মীরা নির্ধারিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন—ফাইল এগোচ্ছে, ই-মেইল যাচ্ছে, রিপোর্ট তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বাজারের পরিবর্তন, গ্রাহকের আচরণ, নতুন প্রতিযোগীর কৌশল বা শিল্পখাতের ভবিষ্যৎ প্রবণতা নিয়ে ভাবার সময় বা আগ্রহ অনেকের মধ্যেই অনুপস্থিত। প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠান কীভাবে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, কিংবা নিজের প্রতিষ্ঠান কোথায় পিছিয়ে পড়ছে—এসব প্রশ্ন যেন অনেকের কাজের ও চিন্তার পরিধির বাইরে।
এই মানসিকতা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে এক ধরনের স্থবিরতা তৈরি করে। বাহ্যিকভাবে কার্যক্রম চলমান থাকলেও ভেতরে ভেতরে অগ্রগতির গতি কমে যায়। এর দীর্ঘমেয়াদি মূল্য দিতে হয় প্রতিষ্ঠানকেই—এমনকি নতুন ধারণা, উদ্ভাবন ও নেতৃত্ব তৈরির সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হয়।
উদ্যোগ ও মালিকানাবোধের সংকট
ভিশনহীনতার অন্যতম লক্ষণ হলো উদ্যোগ নিতে অনীহা। নতুন প্রকল্প, নতুন ক্লায়েন্ট বা নতুন আইডিয়া সামনে এলে অনেক কর্মী সেটিকে সম্ভাবনা নয়, বরং অতিরিক্ত ঝামেলা হিসেবে দেখেন। ‘এটা আমার কাজ নয়’—এই মানসিকতা ধীরে ধীরে কর্পোরেট সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার করে।
সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব যখন পুরোপুরি ব্যবস্থাপনার ওপর ন্যস্ত থাকে, তখন বাস্তবায়নের সময় কর্মীদের দায়বদ্ধতাও কমে যায়। অথচ দায়িত্ববোধ ও মালিকানাবোধ ছাড়া করপোরেট উৎকর্ষ সম্ভব নয়। প্রতিষ্ঠান তখন কর্মী পায়, কিন্তু নেতা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়।
স্বল্পমেয়াদি ফলাফলকেন্দ্রিকতা
মাসিক বা ত্রৈমাসিক লক্ষ্য, বাৎসরিক বোনাস কিংবা পারফরম্যান্স রেটিং—এসব স্বল্পমেয়াদি সূচক কর্পোরেট সিদ্ধান্তে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, অতিরিক্ত নির্ভরতা দীর্ঘমেয়াদি সক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অনেক সময় তাৎক্ষণিক ফলাফল দেখানোর তাগিদে ব্র্যান্ড ভ্যালু, টিম ডেভেলপমেন্ট কিংবা টেকসই ব্যবসা মডেল উপেক্ষিত থেকে যায়।
ভিশনহীন কর্মীরা সাধারণত এই স্বল্পমেয়াদি চক্রেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কারণ এতে ঝুঁকি কম, দায় সীমিত এবং পরিবর্তনের চাপ তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু এর ফলাফল হিসেবে কর্পোরেট ঝুঁকি বাড়ে, ভবিষ্যৎ প্রস্তুতি দুর্বল হয়ে পড়ে।
প্রযুক্তিগত পরিবর্তনে অনীহা
ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন আজ করপোরেট বাস্তবতা। ব্যাংকিং, টেলিযোগাযোগ, উৎপাদন কিংবা সেবা—সব খাতেই ডেটা, অটোমেশন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বাড়ছে। তবু নতুন সফটওয়্যার, নতুন প্রক্রিয়া বা ডেটাভিত্তিক সিদ্ধান্তকে অনেক কর্মী এখনো বাড়তি চাপ হিসেবে দেখেন।
এই মানসিক প্রতিরোধ প্রতিষ্ঠানের গতি কমিয়ে দেয় এবং প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে ফেলে। ভবিষ্যৎমুখী কর্পোরেট সংস্কৃতির জন্য প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকে গ্রহণ করার মানসিকতা অপরিহার্য। শেখার আগ্রহ না থাকলে দক্ষতাও সময়ের সঙ্গে অচল হয়ে পড়ে।
নেতিবাচকতা ও কর্মপরিবেশ
ভিশনহীন কর্মীদের মধ্যে অভিযোগপ্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যায়। ব্যবস্থাপনা, কাজের চাপ কিংবা সহকর্মী—সবকিছু নিয়েই অসন্তোষ প্রকাশ পায়। এই নেতিবাচকতা ধীরে ধীরে পুরো টিমের মনোবল ও সৃজনশীলতাকে ক্ষয় করে।
কর্পোরেট বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘমেয়াদে দক্ষ কর্মী ধরে রাখার সবচেয়ে বড় বাধাগুলোর একটি হলো নেতিবাচক কর্মপরিবেশ। যেখানে ভিশন নেই, সেখানে অনুপ্রেরণাও ধোপে টেকে না।
সময় ব্যবস্থাপনা ও দক্ষতার স্থবিরতা
ভুল অগ্রাধিকার নির্ধারণ, কাজ ফেলে রাখা এবং দক্ষতা উন্নয়নে অনীহা—এসবও ভিশনহীনতার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। প্রশিক্ষণ, মেন্টরিং কিংবা গঠনমূলক ফিডব্যাক গ্রহণে আগ্রহ না থাকলে কর্মীর সক্ষমতা সময়ের সঙ্গে পিছিয়ে পড়ে। কর্পোরেট জগতে শেখা বন্ধ মানেই প্রাসঙ্গিকতা হারানো।
প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রভাব
ভিশনহীন কর্মীরা প্রতিষ্ঠানকে সচল রাখে, কিন্তু নেতৃত্ব তৈরি করে না। তারা স্থিতিশীলতা আনে, কিন্তু গতি আনে না। ফলে প্রতিষ্ঠান আপাতদৃষ্টিতে নিরাপদ থাকলেও উদ্ভাবন, প্রতিযোগিতা ও প্রবৃদ্ধির জায়গায় ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ে।
ভিশন গড়ে তুলতে করপোরেট করণীয়
ভিশন তৈরি মানে কেবল দেয়ালে স্লোগান বা পোস্টার টাঙানো নয়। কর্মীদের দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে উদ্দেশ্য যুক্ত করা, সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া এবং শেখার সংস্কৃতি গড়ে তোলাই এর মূল চাবিকাঠি।
নেতৃত্বকে হতে হবে অনুপ্রেরণাদায়ী—যেখানে কর্মীরা বুঝতে পারবেন, তাঁদের কাজ শুধু দায়িত্ব নয়, প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের অংশ। কর্মীদের মধ্যে সেই দায়িত্ববোধ জাগ্রত করাও হতে হবে কৌশলগত সিদ্ধান্তের অংশ।
শেষ কথা
ভিশনহীন কর্মী করপোরেট খাতের একটি নীরব ঝুঁকি। অবহেলা করলে এই ঝুঁকি ভবিষ্যতে বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। তবে সঠিক নেতৃত্ব, সুস্থ সংস্কৃতি ও মানবসম্পদে বিনিয়োগ থাকলে এই ঝুঁকিই রূপ নিতে পারে অদম্য শক্তিতে।
আজ প্রশ্নটা তাই স্পষ্ট— আমাদের কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো কি কেবল বর্তমান পরিচালনায় ব্যস্ত, নাকি ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরিতে সত্যিই প্রস্তুত?
এই প্রশ্নের উত্তরই নির্ধারণ করবে কর্পোরেট সাফল্যের দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব।
লেখক : এম এম মাহবুব হাসান, ব্যাংকার, উন্নয়ন গবেষক ও লেখক
মন্তব্য করুন