নওগাঁর রাণীনগরে কোটি কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি নিজেদের দখলে নেওয়ার পাঁয়তারা চলছে হালিমা ও গয়ের আলী গংদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ উঠেছে ভুয়া দলিলের মাধ্যমে প্রায় শতাধিক বিঘা ভিপি ও খাস জমি তারা নিজেদের নামে পেতে চায়। সেজন্য আদালতে মিথ্যে তথ্য দিয়ে সরকারকে বিবাদী করে মামলা করেছে দলিল গ্রহীতা ও তাদের ওয়ারিশরা। যদিও সম্পত্তিগুলো সাধারণ জনগণের কাছে লিজ দেওয়া আছে। অবশ্য দলিল থেকে সরকারি হাট ও খেলার মাঠ বাদ যাবে বলে স্বীকার করেছেন বাদীপক্ষের একাধিকজন।
জানা যায়, উপজেলার কাশিমপুর রাজবাড়ির জমিদার অন্নদা প্রসন্ন লাহিড়ি দেশ ভাগের সময় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চলে যান। ফলে রাজার রেখে যাওয়া শত শত বিঘা জমিগুলো ভিপি ও খাস হয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ করে সরকারি শতাধিক বিঘা জমির মালিক বের হন। ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর বিনিময় দলিলের মাধ্যমে মফিজ উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি তার নামে রেজিস্ট্রি দেখায়, যেখানে দাতা অন্নদা প্রসন্ন লাহিড়ি উল্লেখ করা আছে। অথচ বিনিময় দলিল ১৯৬৫ সালের পর আর হয় না বলে জানা যায়। ফলে ভবিষ্যৎ সমস্যা হতে পারে জেনে মফিজ উদ্দিন জমিগুলো বিক্রয় করে দেন। তার কাছ থেকে ১৯৬৮ সালের ২৩ জুলাই মোবারক আলী, হালিমা খাতুন ও সৈয়দ আয়েন উদ্দিনসহ চারজন দলিল করে নেন। একদিন পর ২৪ জুলাই আরেক গ্রহীতা গয়ের আলী খাঁ নামে এক ব্যক্তি তার নামে দলিল করে নেন।
এরপর গ্রহীতা গয়ের আলী খাঁ আবার বিক্রি করে দেন। তার কাছ থেকে ১০৩৬৩ নং দলিল করা হয় ১৯৭০ সালের ২০ জুলাই। যার গ্রহীতা কুজাইল গ্রামের মৃত নমির উদ্দিন প্রাং এর ছেলে শহিদুল ইসলাম টুকু, দুর্গাপুর গ্রামের মৃত আব্দুল গফুরের ছেলে আমিরুল ইসলাম, জাহানারা বিবি ও রোকেয়া বিবি। এই দলিলটির গ্রহীতা আমিরুল ইসলামের নামে আবার জন্মের আগেই রেজিস্ট্রি দেখানো হয়েছে। এছাড়া তার জন্ম তারিখ দুই রকম পাওয়া যায়। জাতীয় পরিচয়পত্রে ’৭৫ সালে জন্ম আর আতাইকুলা জনকল্যাণ উচ্চ বিদ্যালয়ে দেওয়া আছে ’৭২ সাল। এসব দলিল আত্রাই সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দেখানো হয়েছে। আর সহযোগিতা করেছেন তৎকালীন রাণীনগর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের নকল নবিশ কুজাইল গ্রামের মৃত আফছার খাঁর ছেলে আফজাল হোসেন।
এরপর নিজেদের দখলে নেওয়ার জন্য সরকারকে বিবাদী করে ২০১২ সালের ১৪ আগস্ট মামলা করে হালিমাসহ ২৮ জন। গত ২০২১ সালের ২৫ অক্টোবর সিনিয়র সহকারী জজ আদালত পত্নীতলা ট্রাইবুনাল-৫, নওগাঁর বিচারক ৩২৯/২০১২নং অর্পিত মামলার রায় প্রদান করেন তাদের পক্ষে। এই রায়ের বিরুদ্ধে সরকার ১৭/২০২২ অর্পিত মামলায় ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ২য় অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতে আপিল করেন। এবং আপিল মামলা চলাকালীন সময়ে সরকার পক্ষের সন্দেহ হওয়ায় গত ২৩ সালের ৯ মার্চ ভিপি কৌঁসুলি আবু রশিদ তৌফিক মান্নান বাদীপক্ষের দলিলের সঠিকতা জানতে রাজশাহী রেকর্ড রুমে চিঠি পাঠান। চিঠির প্রেক্ষিতে একই বছরের ২৬ এপ্রিল ২৯৪ স্মারকে দলিলগুলোর সঠিকতা ও ভিত্তি নেই উল্লেখ করে রাজশাহী রেকর্ডরুম থেকে পত্রের মাধ্যমে জানানো হয়। যার মূল কপি গত ২ আগস্টে/২৩ আদালতে দাখিল করা আছে। এ ছাড়া সরকার পক্ষ তাদের দলিলগুলো ভুয়া প্রমাণের জন্য সুপ্রিম কোর্টে লিভ টু আপিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
অপরদিকে সরকার এখনও পর্যন্ত ওই সকল জমিগুলো লিজ দিয়ে রেখেছেন এবং সেখান থেকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করছেন এবং কাউকে চেকের রসিদ দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ সম্প্রতি সরকারিভাবে কিছু পুকুর ও হাট লিজ দেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে লিজ গ্রহীতাদের মধ্যে নাম না প্রকাশে একজন জানান, গত ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের পর আর কোনো বিনিময় দলিল হওয়া সম্ভব নয়। অথচ তারা ১৯৬৭ সালের বিনিময় দলিল দেখাচ্ছে। এ ছাড়া ১৯৬৮ সালের জুলাই মাসের ২৩ ও ২৪ তারিখে বাদীপক্ষের দাখিলকৃত দলিলের সিরিয়াল নং ১২১৭০ ও ১২১৭১ এবং একই তারিখে অন্য নামীয় তিনটি দলিল উঠিয়ে দেখা যায়, যার সিরিয়াল নং ১০১৩৫, ১০১৩৯ ও ১০১৯৯। যা এক দিনে সিরিয়াল নং দুই হাজারের অধিক। যেটা অবিশ্বাস্য।
তিনি বলেন, ১০৩৬৩ নং দলিলে ঐতিহ্যবাহী কুজাইল হাট, ফুটবল খেলার মাঠ ও কয়েকটি পুকুরসহ বহু সরকারি সম্পত্তি অন্তর্ভুক্ত আছে। এমনকি তাদের দলিলে তৎকালীন কাশিমপুর দাতব্য চিকিৎসালয় পর্যন্ত আছে। তাই তাদের ভুয়া দলিলের পক্ষে আদালত যদি রায় বলবৎ রাখেন, তাহলে সরকার প্রায় ৩০ কোটি টাকার এক শত ২৫ বিঘা সম্পত্তি হারাবে, সেই সঙ্গে হারাবে কোটি টাকার রাজস্ব। আর রাজশাহী রেকর্ড রুম থেকে বাদী পক্ষের দাখিলকৃত দলিলের সঠিকতা নিরপেক্ষ কোনো কর্মকর্তার মাধ্যমে যাচাই করার অনুরোধ রইল। কারণ এখানে আমরা প্রায় শতাধিক লিজ গ্রহীতা সরকারকে রাজস্ব দিয়ে আসছি।
অভিযোগ ও মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে বাদী আমিরুল ইসলাম নাহিদ মোবাইল ফোনে বলেন, মামলাটি আদালতে চলমান আছে। আমরা একবার ডিগ্রি পেয়েছি। তবে দলিলে সরকারি যে খেলার মাঠ ও হাট আছে সেটা বাদ যাবে। কারণ খাস হয়ে গেছে। আর বাকি প্রায় সকল সম্পত্তি আমরা পাব। তার জন্ম ১৯৭০ সালের আগে, কিন্তু পড়াশোনা দেরিতে করায় তিনি বিদ্যালয়ে ৭৫ সাল করে নিয়েছেন।
আর দলিলের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই জমিটি আগে বেশ কয়েকজন কিনে দলিল করেছিল। এরপর তারা গয়ের আলী খাঁর কাছ থেকে কিনে দলিল করে নিয়েছেন। এ ছাড়া তার জন্ম তারিখ দুই তিন রকমের আছে বলে তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন।
আরেক বাদী দলিল গ্রহীতা মোবারক আলীর ছেলে মকলেছুর রহমান মোবাইল ফোনে কালবেলাকে বলেন, পূর্ব দিনাজপুরের ওখানে বিনিময় দলিলটি হয়েছে। এরপর আমরা কিনে নিয়েছি। তবে ১৯৬৫ সালের পর বিনিময় দলিল হয় কিনা সে বিষয়ে জানেন না তিনি। আর দলিলে সরকারি খেলার মাঠ, হাট ও খাসপুকুরসহ শতাধিক জমি আছে স্বীকার করে দলিল থেকে হাট ও খেলার মাঠ বাদ যাবে বলে তিনিও জানালেন। অবশ্য সরকারি হাট ও খেলার মাঠ কীভাবে দলিল হয় এ বিষয়ে তিনি কোনো সঠিক জবাব না দিয়ে বলেন, আমরা কি সরকারি সম্পত্তি নিতে পারবো? এখনও পুরোদমে পাইনি। সরকার দিলে আমরা পাব, না দিলে পাব না।
জানতে চাইলে ভিপি কৌঁসুলি আবু রশিদ তৌফিক মান্নান কালবেলাকে বলেন, আমার বিশ্বাস তারা কোনো প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। কারণ রাজশাহী রেকর্ড রুমে তাদের দলিলের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব পাচ্ছে ওই সকল সম্পত্তি থেকে। তাই এটা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। বর্তমানে মামলাটি চলমান আছে। এ ছাড়া উচ্চ আদালতে লিভ টু আপিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার।
আর সরকারি স্বার্থের জন্য আইনগতভাবে মোকাবিলা করবেন বলে মোবাইল ফোনে কালবেলাকে জানান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সোহেল রানা।
মন্তব্য করুন