নীলফামারী ডিমলায় জমি অধিগ্রহণ না করেই ব্যক্তি মালিকানাধীন তিন ফসলি কৃষিজমিতে জলাধার খনন, অবৈধ ড্রেজার (শ্যালো ইঞ্জিন চালিত মেশিন) বসিয়ে বালু উত্তোলন বন্ধসহ সাত শতাধিক কৃষকের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ ও গণজমায়েত করেছেন ভুক্তভোগী কৃষক ও এলাকাবাসী।
বুধবার (১৭ জুলাই) দুপুরে উপজেলার বুড়িতিস্তা নদীর কেয়ার বাজার এলাকায় এ গণজমায়েত করেন তারা।
এতে সভাপতিত্ব করেন জমির মালিক ও স্থানীয় বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা ময়েজউদ্দিন আহমেদ। এ সময় বক্তব্য দেন আব্দুল আলিম, জাহেদুল ইসলাম, আব্দুল লতিফ, নুর আলম, লায়ন ইসলাম, হাবিব হাসান, আশুতোষ কুমার প্রমুখ। এছাড়াও সেখানে উপস্থিত ছিলেন হাজারো গ্রামবাসী।
গণজমায়েতে বক্তারা বলেন, ডিমলা উপজেলার কুঠিরডাঙ্গা, রামডাঙ্গা, পঁচারহাট ও পার্শ্ববর্তী জলঢাকা উপজেলার চিড়াভিজা গোলনা ও খারিজা গোলনা এলাকার ৫টি মৌজায় প্রায় ৯৫৭ একর তিন ফসলি কৃষিজমি এবং ১৬০ একর জমিতে জনবসতি ও সরকারি স্থাপনা রয়েছে। জমির মালিকানা সূত্রে এসব জমিতে চাষাবাদ ও বসবাস করছেন তারা।
সাম্প্রতিক সময়ে জমির মালিকদের না জানিয়ে হাজারো কৃষকের ৯৫৭ একর বৈধ কৃষি জমি দখলে নিয়ে জলাধার খনন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। খননের জন্য বসানো হয়েছে অর্ধশতাধিক অবৈধ ড্রেজার মেশিন। জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত কোনো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি। তাদের বৈধ মালিকানা জমি বেআইনিভাবে দখল করা হয়েছে। ওই জমিতে কৃষকরা এখন যেতে পারছেন না। পাউবো ও ঠিকাদারের লোকজন জমির দখল ছাড়তে কৃষকদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে চাপ প্রয়োগ করছে। জোরপূর্বক খননের জন্য তারা ৭০০ কৃষকের নামে দফায় দফায় কয়েকটি মিথ্যা মামলা করে হয়রানি করছে।
বক্তারা বলেন, ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতায় জলাধার নির্মাণের পরিকল্পনায় পাঁচটি গ্রামের ১২১৭ একর জমি হুকুম দখলে (মৌখিক সম্মতি) অধিগ্রহণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পরবর্তী সময়ে সেটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় সরকার জমি অধিগ্রহণ করেননি। এরপর থেকে ওই জমিতে মালিকানা সূত্রে স্থানীয় বাসিন্দারা কৃষিকাজ করছেন। ২০১০ সালে পাউবো কর্তৃপক্ষ জমিগুলোর মালিকানা দাবি করে ৪৯২ দশমিক ৭১ হেক্টর ব্যক্তি মালিকানা জমি মেসার্স তুষুকা নামক ঠিকাদারি রিসোর্স লিমিটেডকে ইজারা দেন। তুষুকা কর্তৃপক্ষ ওই জমিতে কার্যক্রম শুরু করলে এলাকাবাসী বাধা দেয়। এক পর্যায়ে জমি রক্ষায় প্রকৃত মালিকরা উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হলে এক আদেশে তাদের কার্যক্রম স্থগিত হয়। এরপর থেকে কৃষকেরা ফসল উৎপাদন করে নিজেদের চাহিদা মেটানোর পাশাপশি জাতীয় খাদ্য চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রাখছে।
এদিকে পাউবো কর্তৃপক্ষ আবারও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব তিন ফসলি জমিতে উঁচু বাঁধ দিয়ে জলাধার খননের কাজ শুরু করে। খননের নামে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত যন্ত্র দিয়ে অবৈধভাবে বালু তুলে বিক্রি করছে পাউবোর ঠিকাদার।
জমির মালিক ও স্থানীয়দের দাবি, নদী খননে তাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তাদের বৈধ মালিকানার তিন ফসলি কৃষিজমি দখলে নিয়ে জলাধার খনন করছে পাউবো। এতে বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ফসল উৎপাদন কমে যাবে। এ ছাড়া খননের নামে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তুলে বিক্রি করছে পাউবোর ঠিকাদার। এতে ক্ষতির মুখে পড়ছেন নদী পাড়ের বাসিন্দারা। নদী ভাঙ্গনে বিলীন হচ্ছে ফসলি জমি ও বসতবাড়ি।
জমির মালিক আল-আমিন,স্বপন, আব্দুল আলিমসহ অন্তত ৩০ জন বাসিন্দা বলেন, জলাধার খনন করা হলে পরিবার নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে। তিন হাজার পরিবারের ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া অন্য উপায় থাকবে না। জমির সীমানা নির্ধারণের কথা বলে পাউবো মিথ্যাচার করেছে। তারা জমি অধিগ্রহণের কোনো বৈধ কাগজপত্র দেখাতে না পেরে গ্রামবাসীকে মামলার ফাঁদে আটকে খননকাজ শুরু করেছে।
স্থানীয়দের ভাষ্য, বুড়িতিস্তা একটি মরা নদী। নদীর উৎস মুখেই পানি নেই। পানির প্রবাহ নিশ্চিত না করে জলাধার খনন শুধু সরকারি অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই হবে না। শুষ্ক মৌসুমে এই প্রকল্প কোনো কাজেই আসবে না। এ ছাড়া যে এলাকায় জলাধার খনন করা হচ্ছে তার এক কিলোমিটার দূরেই রয়েছে দেশের বৃহত্তম তিস্তা সেচ প্রকল্প।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতায় ৫টি প্যাকেজে বুড়িতিস্তা নদী খনন করছে নীলফামারী পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
পাউবো সূত্রে আরও জানা গেছে, জলাধার নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ফলে ১ হাজার ২১৭ একর জলাধারে প্রথম পর্যায়ে নদী সম্প্রসারণ বা খনন করা হবে ৬৬৭ একর। খনন শেষে ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার ৫ হাজার ৫০০ একর জমিতে নিরবচ্ছিন্ন সেচ সুবিধা পাওয়া যাবে।
নীলফামারী পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান কালবেলাকে বলেন, পাউবোর অধিগ্রহণ করা জমিতে খনন কাজ শুরু করা হয়েছে। ব্যক্তিগত কারো জায়গায় খনন করা হচ্ছে না।
নিষিদ্ধ শ্যালো ইঞ্জিনচালিত মেশিন দিয়ে খননের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এতে সরকারের বিপুল অর্থ সাশ্রয় হবে। এ কারণে আমরা অনুমতি নিয়েছি। তবে এই মুহূর্তে অনুমতির কোনো কাগজপত্র দেখাতে রাজি হননি তিনি।
মন্তব্য করুন