ঢাকা জেলার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে চাঞ্চল্যকর ট্রিপল মার্ডার মামলার রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। প্রেম, বিয়ে বিচ্ছেদ, দাম্পত্য কলহ ও প্রতিহিংসার জটিল আবর্তে নৃশংসভাবে খুন হন দুই নারীসহ এক শিশু।
হত্যার শিকার তিনজন হলেন নূপুর (২৫), বিথী আক্তার (২৪) ও তার শিশু পুত্র রাফসান (৪)।
ঘটনায় মূল অভিযুক্ত মো. মহিউদ্দিন হাওলাদার ওরফে শিমুলকে (৩১) গ্রেপ্তার করেছে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ।
সোমবার (২৮ এপ্রিল) বিকেলে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ তথ্য নিশ্চিত করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কেরানীগঞ্জ সার্কেল) জাহাঙ্গীর আলম।
সংবাদ সম্মেলনে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তিনি জানান, গত ২৫ এপ্রিল জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর মাধ্যমে খবর আসে যে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার কালিগঞ্জ মাকসুদা গার্ডেন সিটির সামনে এক অজ্ঞাত নারীর খণ্ডিত মরদেহ পড়ে আছে।
তাৎক্ষণিকভাবে টহলরত পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে মরদেহের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে। পরে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কেরানীগঞ্জ সার্কেল) এবং দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
মরদেহটি এতটাই বিকৃত ছিল যে তাৎক্ষণিকভাবে পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। পরে হাসনাবাদ নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি সংবাদ দেয়, পোস্তগোলা ব্রিজের দক্ষিণ পাশে বুড়িগঙ্গা নদীতে ভেসে থাকা আরও ৩টি খণ্ডিত দেহাংশ পাওয়া গেছে।
ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ, গোয়েন্দা তথ্য এবং তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় অভিযান চালায়। রোববার (২৭ এপ্রিল) কদমতলী থানাধীন জুরাইন রেললাইন এলাকা থেকে প্রধান অভিযুক্ত মো. মহিউদ্দিন হাওলাদার ওরফে শিমুলকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তারের পর ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে মহিউদ্দিন হাওলাদার ঘটনার রোমহর্ষক বর্ণনা দেন এবং হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি স্বীকার করেন।
তার ভাষ্যমতে, নিহত বিথী আক্তার (২৪) আগে তার কারখানায় চাকরি করতেন। কর্মস্থলে পরিচয়ের সূত্র ধরে তাদের প্রেম হয় এবং ২০১৭ সালে গোপনে বিয়ে করেন। তবে মহিউদ্দিনের পরিবার বিষয়টি মেনে না নেওয়ায় তারা পরে বিবাহবিচ্ছেদ করে। বিথী এরপর রুবেল ইসলাম নামে অপর এক ব্যক্তিকে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন এবং তাদের ঘরে জন্ম নেয় শিশু রাফসান (৪)।
পরে মহিউদ্দিন ও বিথী আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (ফেসবুক) যোগাযোগ শুরু করে এবং তাদের সম্পর্ক পুনরায় গড়ে ওঠে। বিথী স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে মহিউদ্দিনের দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হীরেরবাগ এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন।
কিন্তু একই সময়ে মহিউদ্দিন তার প্রথম স্ত্রীকেও অন্য বাসায় রেখে সংসার করছিলেন, যা নিয়ে বিথী ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। এতে তাদের মধ্যে বারবার ঝগড়া হয়।
অভিযুক্ত মহিউদ্দিন জানান, গত ২৫ এপ্রিল সকালে ঝগড়ার একপর্যায়ে সে বিথীকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। শিশু রাফসান মায়ের এ হত্যাকাণ্ড দেখে ফেলায় তাকেও একইভাবে হত্যা করে। ঘটনা প্রত্যক্ষ করে ফেলা একই বাসার সাবলেট ভাড়াটিয়া নূপুর (২৫) চিৎকারের চেষ্টা করলে তাকেও হত্যা করা হয়।
পরে মহিউদ্দিন বাসা তালাবদ্ধ করে চলে যায় এবং পরে ফিরে এসে মৃতদেহগুলোকে টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন জায়গায় ফেলে দেয়। বিথী ও নূপুরের মৃতদেহের খণ্ডিত অংশ নদীতে এবং রাস্তার পাশে ফেলে দেওয়া হয়। শিশুর দেহাংশ একটি ঝোঁপে ফেলে আসা হয়। ঘটনার পর ব্যবহৃত চাকু এবং নিহতদের মোবাইল ফোনও নদীতে ফেলে দেয় মহিউদ্দিন।
পুলিশের অভিযানে বেয়ারা পূর্বপাড়া এলাকার একটি ঝোঁপ থেকে শিশু রাফসানের অর্ধগলিত দেহাংশ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার করা মৃতদেহগুলোর সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
ভিক্টিম বিথীর স্বামী ও শিশু রাফসানের বাবা রুবেল জানান, কিছুদিন ধরে ব্যবসা করবে বলে একা বাসা নেয় বিথী। কারখানা মালিক শিমুলের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন ছিল বলে আমাকে বিথী জানায়। তবে শিমুলের স্ত্রী আমার স্ত্রীর সঙ্গে শিমুলের অবৈধ সম্পর্কের কথা জানিয়েছিল আমি বিশ্বাস করিনি। আমার ছেলে রাফসানকে আমি মাদ্রাসায় ভর্তি করাতে চেয়েছিলাম। আমি আর স্ত্রী ও ছেলে হত্যাকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কেরানীগঞ্জ সার্কেল) মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, মূলত অবৈধ সম্পর্কের পর বিয়ে করার চাপের কারণে বিথীকে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
শিশু রাফসান ও সাব লেট ভাড়াটিয়া নূপুরকে দেখে ফেলায় হত্যা করা হয়। ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আলামত উদ্ধার এবং আসামির দেওয়া স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে।
মন্তব্য করুন