মাহমুদুল আলম বাবু একসময় সাধুরপাড়া ইউনিয়নের নিজ গ্রামের কামালের বাড়িতে মুদির দোকান চালিয়ে কোনোরকমে দিনাতিপাত করত। এরপর চাচাতো ভাই ইঞ্জিনিয়ার হারুনের ঠিকাদারি লাইসেন্সে তার সহযোগিতায় বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির টাওয়ার নির্মাণ করে অর্থ উপার্জন শুরু করলে তার দিন পাল্টে যায়। ছাত্রজীবনে জাতীয় পার্টির ছাত্রসংগঠন জাতীয় ছাত্রসমাজের রাজনীতি করলেও পরবর্তীতে ভোল পাল্টে রাজনীতি ছেড়ে নিরপেক্ষতার ভান ধরে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৪-৯৫ সালের দিকে জাতীয় ছাত্রসমাজের প্রথম সারির কর্মী হিসেবে পরিচিত ছিল। ঠিকাদারি করে টাকা পয়সা কামিয়ে ২০১১ সালে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ভিড়ে, ২০০৮ সালের নির্বাচনের পরে যেভাবে সারা বাংলাদেশে অনেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগে ভিড়েই ইউপি নির্বাচনে অংশ নিয়ে পাশ করতে না পারলেও ২০১৪ সালে সাধুরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নিতে সক্ষম হয়। তারপর থেকে বকশীগঞ্জ উপজেলা তথা জামালপুর জেলার আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে জায়গা করে নেয়।
ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকায় খুব সহজেই ২০১৬ সালে ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিট পায় বাবু। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে দ্রুত নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে সক্ষম হয় মাহমুদুল আলম বাবু।
জানা যায়, নারী লোভী বাবু টাকা আর ক্ষমতার দম্ভ দেখিয়ে চলত। পুলিশের সাবেক এক ডিআইজির চাচাতো ভাই হিসেবে সর্বস্তরে শক্তি প্রদর্শনের দুঃসাহস দেখাতে থাকে। এরপর থেকে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে বাবু। হয়ে যায় সাধুরপাড়া ইউনিয়নের অঘোষিত সম্রাট।
২০১৬ সালের নির্বাচনের বিজয় তার জীবনে যেন চিরস্থায়ী আশীর্বাদ হয়ে ফিরে আসে। ২০১৪ সালে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সম্মেলনের পর আর কোনো সম্মেলন হয়নি, তাই পদে থেকে ২০২১ সালে ফের নৌকার মাঝি হয়ে ফিরে আসে মাহমুদুল আলম বাবু। একদিকে ২ বারের নৌকার চেয়ারম্যান, অন্যদিকে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ৯ বছরের সাধারণ সম্পাদক। ঠেকায় কে তাকে? তার ছেলে রিফাতও তার বাবার মতোই বেপরোয়া হয়ে ওঠে ক্ষমতার দম্ভে। নারী লোভী বাবুর চরিত্র ফাঁস হয় যখন তার দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিনা আক্তার দৃশ্যপটে আসে।
জানা যায়, সাবিনাকে সে দুবার বিয়ে করে। দ্বিতীয়বার বিয়ের পর সাবিনার কোলে বাচ্চা আসার পর পুনরায় বাবু সাবিনাকে অস্বীকার করে। যখন সাবিনা তার অধিকার ফিরে পেতে চায়, তখন দুঃসাহসিক সংবাদকর্মী গোলাম রব্বানী নাদিম একের পর এক সংবাদ প্রকাশ করতে থাকে। এরপরই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে নারী লোভী বাবু।
বারবার বাবুর বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করায় নাদিম ও অন্যদের নামে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করেন বাবু। কিন্তু মামলার মেরিট না থাকায় তা খারিজ করে দেন ময়মনসিংহের সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক। মামলা খারিজের চার ঘণ্টার মধ্যে হামলার শিকার হন সাংবাদিক নাদিম।
সাংবাদিক ও সচেতন নাগরিকদের ধারণা, বাবু হয়তো জানত নাদিমকে কোনোভাবেই আটকানো যাবে না। তাই আগে থেকেই পরিকল্পনা করতে থাকে তাকে কীভাবে শায়েস্তা করতে পারবে। মামলা দিয়েও ব্যর্থ হয়ে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক নাদিমকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় বাবু ও তার পোষা সন্ত্রাসীরা।
এরই অংশ হিসেবে বাবু সশরীরে উপস্থিত থেকে হামলার নেতৃত্ব দেয় বলে জানিয়েছেন নাদিমের সহকর্মী এবং সহযোগী মুজাহিদ বাবু।
রাত ১০টার দিকে অদূরে অন্ধকার গলিতে দাঁড়িয়ে থেকে ছেলে রিফাত ও অন্য সহযোগী সন্ত্রাসীদের দিয়ে হামলা করায় নাদিমের ওপর। এলোপাতাড়ি মারধর করে ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে পালিয়ে যায় তারা।
বৃহস্পতিবার (১৫ জুন) বিকেল ৩টায় ময়মনসিংহের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাংবাদিক নাদিমের মৃত্যু হয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে জেলায় কর্মরত সাংবাদিকরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তার আগেই নাদিমের ওপর হামলার একটি সিসিটিভি ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সাংবাদিকদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হলে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় জামালপুর প্রেস ক্লাবসহ বিভিন্ন জায়গায়। পুলিশ দ্রুত চারজনকে আটক করে। এরপর আরও দুজনকে আটক করলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায় চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু।
শুক্রবার (১৬ জুন) সকালে সাংবাদিক নাদিমের জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়। ওই জানাজায় উপস্থিত হয়ে বকশীগঞ্জ থানার ওসি সোহেল রানা বলেন, দ্রুত চেয়ারম্যান বাবুকে গ্রেপ্তার করা হবে।
মন্তব্য করুন