দিনাজপুরের পার্বতীপুরে মধ্যপাড়া পাথর খনিটি যেই প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে লোকসান কাটিয়ে লাভজনক হয়েছে সেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিটিসির বিরুদ্ধে চলছে মিথ্যা প্রপাগান্ডা। মধ্যপাড়ার এই খনিতে বর্তমানে ১৪টি ইয়ার্ডে প্রায় ১১ লাখ টন পাথর মজুত রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় পৌনে ৪০০ কোটি টাকা।
এরমধ্যে রেলপথে ৭ লাখ ৭০ হাজার টন ব্লাস্ট পাথর এবং নদী শাসনের কাজে ব্যবহৃত হওয়ার জন্য বোল্ডার ৩ লাখ ৩২ হাজার টন প্রস্তুত রাখা হয়েছে। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড মজুদকৃত পাথর নিচ্ছে না। ফলে খনি কর্তৃপক্ষ বিপাকে পড়েছে। ইতিমধ্যে ধারদেনা করে ঠিকাদারের বিল, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা পরিশোধ এবং উৎপাদন খরচ, ভ্যাট ও আয়কর সরকারি কোষাগারে প্রদান করেছে খনি কর্তৃপক্ষ। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪ জুন পর্যন্ত প্রায় ২৪৬ কোটি টাকার ৯ লাখ ২০ হাজার টন পাথর বিক্রি হয়েছে।
এ বিষয়ে মধ্যপাড়া পাথর খনির উপমহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) সৈয়দ রফিজুল ইসলাম বলেন, আমদানি পাথরের উপর শুল্ক বৃদ্ধি এবং মধ্যপাড়ার পাথরের ট্যারিফ ভ্যালু বৃদ্ধি প্রয়োজন। এতে পাথরের বিক্রিতে সুবিধা হবে এবং দেশের একমাত্র ভূগর্ভস্থ পাথর খনিটিকেও বাঁচিয়ে রাখা যাবে।
তিনি বলেন, রেল ও পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নিলে আজকে পাথরে মজুদ হতো না। মধ্যপাড়ার পাথর যমুনা সেতুতে ব্যবহার করা হয়নি। বর্তমান দেশের মেঘা প্রজেক্ট বন্ধ থাকায় এই পাথর ব্যবহার হচ্ছে না। আশার কথা হচ্ছে, ২০২৫ সালের গত ১২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম রেলে পাথর ব্যবহারের বিষয়ে মধ্যপাড়ার দ্বিমুখী চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। ইতোমধ্যে দুই সপ্তাহ পূর্বে ২০ হাজার মেট্রিক টন নিয়েছে। রেলের পূর্বাঞ্চলে অনুরূপভাবে চুক্তির বিষয়টি চলমান রয়েছে। তবে, পানি উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ে আলোচনা চলছে অচিরে মধ্যপাড়ার বোল্ডার অন্তর্ভুক্ত হবে।
দেশের একমাত্র খনিটি ২০০৭ সালে বাণিজ্যিকভাবে পাথর উৎপাদনে যায়। কিন্তু প্রতিদিন পাথর উত্তোলন হয় ৭শ’ থেকে ৮শ’ টন। ফলে খনিটি লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ২০১৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর সরকারের সঙ্গে উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খনির উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তি হয় বেলারুশের জেএসসি ট্রেস্ট সকটোস্ট্রয় ও জার্মানীয়া কর্পোরেশন লিমিটেড নিয়ে গঠিত জার্মানীয়া-ট্রেস্ট কনসোর্টিয়ামের (জিটিসি) সঙ্গে। জিটিসি ইউক্রেন, রাশিয়ান ও বেলারুশের সুদক্ষ মাইনিং বিশেষজ্ঞ দল ও দেশীয় শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে পাথর খনি থেকে দৈনিক সাড়ে ৫ হাজার টন পাথর উত্তোলন করে। ফলে খনিটি লোকসান কাটিয়ে লাভের মুখ দেখতে শুরু করে। জিটিসির হাতে খনিটি লাভজনক হলেও অপপ্রচার চলছেই খনির ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান জিটিসির বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, জিটিসির হাত ধরে গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মধ্যপাড়া পাথর খনিটি লাভের মুখ দেখতে শুরু করে। সেটি টানা ৫ বছর ধরে অব্যাহত রয়েছে। জার্মানীয়া-ট্রেস্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি) খনির দায়িত্ব গ্রহণের পর জিটিসিকে নানা প্রতিকূলতা ও অপপ্রচারের শিকার হতে হয়েছে। জিটিসির বিরুদ্ধে পূর্বের ধারাবাহিকতায় মিথ্যা প্রোপাগান্ডা এখনও চলমান। সকল প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে জিটিসি দক্ষ ব্যবস্থাপনায় বিদেশি খনি বিশেষজ্ঞ ও দেশীয় খনি শ্রমিক দিয়ে খনিটিকে সচল রেখেছে।
খনির একটি সূত্র জানায়, বর্তমান চুক্তিতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অধিক পাথর উত্তোলন করছে জিটিসি। যার পরিমাণ এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৫ লাখ টন। জিটিসির এই পাথর উত্তোলনের ধারা অব্যাহত থাকলে এবং উৎপাদন খরচ, ভ্যাট ও আয়কর প্রদান করে মজুতকৃত লাভের প্রায় পৌনে ৪শ’ কোটি টাকার পাথর বিক্রয় হলে পাথর খনিটি আরও লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জিটিসি খনি এলাকায় মসজিদ নির্মাণ, মাদ্রাসা ও এতিম খানায় সহায়তা প্রদানসহ বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। খনিতে কর্মরত শ্রমিকদের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান এবং খনি এলাকার মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য চ্যারিটি হোম প্রতিষ্ঠা করেছে। সেখানে সপ্তাহে ৫ দিন ১ জন অভিজ্ঞ এমবিবিএস ডাক্তার বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরামর্শ সেবা প্রদান করছেন।
জিটিসির একটি দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, জিটিসি খনিতে কাজ করতে এসেছে। করোনা মহামারির মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তারা খনিটিকে সচল রেখেছিল। কাজের চলমান স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে খনিটি বন্ধ হলে বেকার এবং কর্মহীন হয়ে পড়বে খনি শ্রমিকসহ এলাকার ২০ হাজার মানুষ। খনিটিতে এই পাথর উত্তোলন ধারা অব্যাহত থাকলে পাথর খনিটি আরও লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
পাথর খনির সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (এমজিএমসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী ডিএম জোবায়েদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, পাথর উত্তোলন কাজে বিস্ফোরক কিনতে ছিল ০ শতাংশ। এখন তা ৩৭ শতাংশ করা হয়েছে। পূর্বের ঋণ মওকুফ দরকার। মধ্যপাড়া রেলপথে ১৪ কিলোমিটার রেললাইন সংস্কার হলে পূর্ব রেল অঞ্চলে পাথর পরিবহনে খরচ কমবে। রয়্যালটি হার ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ নির্ধারণ করা দরকার। খনি গেটে স্থানীয় ক্রেতাদের চাহিদা বিবেচনা করে শীঘ্রই ক্রসিং পয়েন্ট স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমান পাথর বিক্রির পরিমাণ অনেক বেড়েছে এবং একইসঙ্গে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সফল আলোচনার মাধ্যমে পাথর বিক্রিতে গতিশীলতা এসেছে। জিটিসির পাথর উত্তোলনের ধারায় অব্যাহত থাকায় উৎপাদন খরচ, ভ্যাট ও আয়কর প্রদান করে খনির ইয়ার্ডে মজুতকৃত লাভের পাথর প্রায় সাড়ে পৌনে ৪শ’ কোটি টাকার। আর এই লাভের পাথর বিক্রি হলে খনিটি আরও লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
মন্তব্য করুন