প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বনসম্পদে সমৃদ্ধ খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা অঞ্চলের পাহাড়ি বনভূমিতে এখন মৌসুমি বনজ খাবার হিসেবে ব্যাপকভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছে বাঁশ কোঁড়ল। বহু পুরোনো ঐতিহ্যবাহী এ খাদ্য উপাদান এখন পাহাড় পেরিয়ে সমতলের বাজারেও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। শুধু স্বাদের জন্য নয়, বরং পুষ্টিগুণ এবং আর্থিক সম্ভাবনার কারণেই এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
পুষ্টিগুণে ভরপুর বাঁশ কোঁড়ল : বাঁশ কোঁড়ল বা বাঁশের কচি অঙ্কুর একটি বনজ খাদ্য। এতে রয়েছে প্রচুর আঁশ, যা হজমে সহায়ক। পাশাপাশি এতে থাকে আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন বি-৬ এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান। পুষ্টিবিদদের মতে, এটি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে এবং এমনকি ক্যান্সার প্রতিরোধেও সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
পর্যটকদের পাতে বাঁশ কোঁড়ল : বর্তমানে পাহাড়ে সংগৃহীত বাঁশ কোঁড়ল শুধু স্থানীয় হাটবাজারেই নয়, খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন হোটেলে পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় খাবারে পরিণত হয়েছে।
পর্যটকরা জানান, বাঁশ কোঁড়ল না খেলে যেন খাগড়াছড়ি ভ্রমণই পূর্ণ হয় না। শুধু তাই নয়, বড় শহরের অর্গানিক ফুড শপ ও সুপার শপেও সরবরাহ করা হচ্ছে। চট্টগ্রামের অভিজাত হোটেল থেকে শুরু করে ঢাকার গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি এলাকায় প্যাকেটজাত বাঁশ কোঁড়ল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২০০-২৫০ টাকা দরে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছেও এটি একটি নতুন আকর্ষণ।
অর্থনীতিতে সম্ভাবনার দ্বার খুলছে : বাঁশ কোঁড়ল নিয়ে গবেষণা এবং নতুন প্রজাতির বাঁশ চাষে উৎসাহ দেওয়া হলে এটি পরিবেশবান্ধব কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া বাঁশভিত্তিক প্রক্রিয়াজাত খাদ্য শিল্প গড়ে তোলা গেলে পাহাড়ের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
নারীদের হাতে জীবিকার চাবিকাঠি : মাটিরাঙ্গার বিভিন্ন স্থানের দুর্গম অঞ্চল থেকে নারীরা বাঁশ কোঁড়ল সংগ্রহ করে মাটিরাঙ্গা বাজারে বিক্রি করছেন। তারা পাহাড়ি শাকসবজির পাশাপাশি প্রত্যেকে বিক্রির জন্য এক আঁটি বাঁশ কোঁড়ল নিয়ে আসেন। এতে তাদের সংসারে আসছে অতিরিক্ত আয়। মৌসুমে একজন প্রতিদিন গড়ে ৫-৭ কেজি কোঁড়ল সংগ্রহ করতে পারেন, যা বিক্রি হয় ৫০-৬০ টাকা কেজি দরে। কখনো কখনো পাইকাররা বাড়ি থেকে কিনে নিয়ে যান।
সরেজমিন দেখা গেছে, মাটিরাঙ্গা সাপ্তাহিক হাটে সারি সারি বাঁশ কোঁড়লের দৃশ্য দেখা যায়। পাহাড়ি নারীরা আঁটি বেঁধে বা খোলস ছাড়িয়ে সাজিয়ে বিক্রি করেন। ক্রেতারা সরাসরি কিনে নিয়ে রান্না করে খান। এখন অনেকে কোঁড়ল শুকিয়ে বা বয়ামে সংরক্ষণ করে সারা বছর বিক্রির পরিকল্পনাও করছেন। এতে মৌসুমি এ পণ্য টেকসই আয়ের উৎসে রূপ নিতে পারে।
রসুলপুরের শ্রাবণী চাকমা বলেন, বাঁশ কোঁড়ল তুলতে বেশি খরচ লাগে না; কিন্তু বিক্রি করে যা পাই তা দিয়ে বাজার সদাই হয়। পরিবারের জন্যও রান্না করে খাই।
মাটিরাঙ্গা ১০ নম্বর এলাকার বাসিন্দা কুহেলিকা বলেন, বাঁশ কোঁড়ল সংগ্রহ করা অনেক কষ্ট, অনেক সময় পা কেটে যায়, আমি গত দুদিন ধরে মশার কামড় খেয়ে বাঁশ কোঁড়ল সংগ্রহ করেছি ৫ কেজির মতো হবে। এগুলো বিক্রি করে বাজার খরচ করব।
মাটিরাঙ্গা সরকারি ডিগ্রি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক আব্দুল হামিদ বলেন, বাঁশগাছ মূলত ঝোপঝাড় ও পাহাড়ি ঢালে জন্মায়। কোঁড়ল সংগ্রহের সময় নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত কেটে নিতে হয় যাতে গাছটি আবার অঙ্কুর গজাতে পারে। সঠিকভাবে সংগ্রহ করলে বাঁশের বন ধ্বংস না করেই দীর্ঘদিন ধরে এ সম্পদ ব্যবহার করা সম্ভব।
মাটিরাঙ্গা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা দেবাশীষ চাকমা বলেন, বাঁশ কোঁড়ল একটি সম্ভাবনাময় ফসল। সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ, প্যাকেজিং ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলে এটি রপ্তানিযোগ্য পণ্যে রূপ নিতে পারে।
মাটিরাঙ্গা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক মিল্টন ত্রিপুরা বলেন, বাঁশ কোঁড়ল একটি সাশ্রয়ী ও পুষ্টিকর খাদ্য। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে বা সুস্থ থাকতে আগ্রহীদের জন্য এটি আদর্শ খাদ্য উপাদান।
মাটিরাঙ্গা উপজেলা রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আতাউর রহমান লস্কর বলেন, বাঁশ কোঁড়ল সংগ্রহে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। একেবারে গোড়া থেকে কাটা উচিত নয়। স্থানীয় জনগণকে আমরা সচেতন করছি যাতে তারা বনজ সম্পদ সংরক্ষণ করে ব্যবহার করেন।
তিনি আরও বলেন, বাঁশ কোঁড়ল এখন আর শুধুই মৌসুমি রান্নার উপকরণ নয় এটি হয়ে উঠছে পুষ্টি, পরিবেশ এবং অর্থনীতির মিলনস্থল। প্রয়োজন শুধু সমন্বিত উদ্যোগ ও নীতিগত সহায়তা। সঠিক পরিকল্পনা, প্রযুক্তি এবং বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে বাঁশ কোঁড়ল হতে পারে পাহাড়ি মানুষের টেকসই উন্নয়নের প্রতীক।
মন্তব্য করুন