‘ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনেরও মন্দিরে’ ১৮৯৬ সালে প্রিয় ভূমি শাহজাদপুরকে ছেড়ে যাওয়ার সময় গানটি লিখেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার ভালোবাসার সখী কোনো মানবী নয়, শাহজাদপুর।
রবীন্দ্র বিশ্লেষকদের মতে, কবিগুরু ১৮৯০ থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত শাহজাদপুরের কাছারি বাড়িতে অবস্থান করেন। ওই ৭ বছরে শাহজাদপুরে বসেই কবি তার বিখ্যাত রচনাগুলো লিখেছেন।
২০১৬ সালে কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত সেই শাহজাদপুরে তার ১৫৫তম জন্মদিনে প্রতিষ্ঠিত হয় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠার সময় বিশ্ববিদ্যালয়টি আন্তর্জাতিক মানের করার ঘোষণা দেওয়া হলেও ৯ বছরে নির্মিত হয়নি ক্যাম্পাস। এমনকি একটি ভবনও বরাদ্দ হয়নি। বিগত সরকারের সাড়ে সাত বছরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গণ্ডিও পার হয়নি প্রকল্পটি। বিশ্বকবির নামাঙ্কিত প্রকল্পটি ৮ বছর ধরে মন্ত্রণালয়ে যাচ্ছে আর ফিরেছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের কর্মকর্তাদের।
এবার বাধ্য হয়ে ক্যাম্পাসের ডিপিপি অনুমোদনের দাবিতে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এরই মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য মহাসড়ক ব্লকেডের মতো কঠোর আন্দোলন শুরু করেছেন শিক্ষার্থীরা। সরকার থেকে ইতিবাচক সাড়া না পেলে উত্তরবঙ্গের রেলপথ ব্লকেড, আমরণ অনশনের হুঁশিয়ারিও দিয়েছে তারা।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০১৬ সালে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হলেও ২০১৮ সালে ভাড়া করা ভবনে শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু হয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ১ হাজার ২শ শিক্ষার্থী, ৩৪ শিক্ষক, ৫৪ কর্মকর্তা ও ১০৭ কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন। চারটি অনুষদের অধীন বাংলা, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ম্যানেজমেন্ট এবং সংগীত এ পাঁচটি বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষের পাঠদান চলছে। বিগত ৭ বছর ধরে শাহজাদপুরের বিভিন্ন প্রান্তে ৮টি ভাড়া ভবনে শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চলছে।
জাকারিয়া জিহাদ, রায়হান, হৃদয় সরকারসহ রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলেন, ভাড়া দিয়ে কতটা কষ্ট করে ক্লাস করতে হয় সেটা বলে বোঝাতে পারব না। দূর-দূরান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকটের কারণে অনেক কষ্ট করতে হয়। আমরা স্বাভাবিকভাবে পড়াশোনা করতে পারছি না। একটি ক্লাস যখন চলে অন্য ক্লাসের শিক্ষার্থীদের বাইর দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। এমন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এভাবে চলতে পারে না। সব শর্ত পূরণ করা হলেও ক্যাম্পাস প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) বৈঠকের এজেন্ডায় স্থান না পাওয়া দুরভিসন্ধিমূলক।
শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, কয়েক বছর ধরেই ক্যাম্পাসের দাবিতে আন্দোলন করছি। গত ১৯ জানুয়ারি থেকে টানা ১১ দিন আন্দোলনের পর কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে স্থগিত করি। পরে ৭ মে একনেক সভায় প্রকল্পের ডিপিপির নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হলেও পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান পরিদর্শন করতে চান।
গত ১৬ জুন তিনি পরিদর্শনে এসে বলেছিলেন, এটা অনুমোদন হয়েই গেছে শুধু আমি এসেছি দেখার জন্য। এরপর তিনি চলে গিয়ে কি প্রতিবেদন দিলেন, প্রকল্প আর একনেক সভায় ওঠেনি। ২৪ জুন ও ২৭ জুলাই দুটি একনেক সভা যাওয়ার পর আমরা ২৬ জুলাই থেকে আবারও আন্দোলন শুরু করেছি।
শাহজাদপুরে ঢাকা-পাবনা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ ও রাস্তায় ক্লাস কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। সরকারের টনক নড়েনি। হাটিকুমরুল গোলচত্বরে ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের সব সড়ক যোগাযোগ বন্ধ করা হয়েছে। শুধু শিক্ষার্থী নয়, এ আন্দোলনের সঙ্গে শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও একাত্মতা প্রকাশ করে পৃথক কর্মসূচি পালন করছে। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ রাজনৈতিক দলের নেতারাও আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন। আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আর পেছনে ফেরার অবকাশ নেই। ক্যাম্পাস বাস্তবায়ন না করে রাজপথ ছাড়ব না।
এদিকে শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনে দুর্ভোগের যেন অন্ত নেই উত্তরাঞ্চলবাসীর। তারপরও স্থানীয় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে।
সোমবার (১১ আগস্ট) ঢাকা-পাবনা মহাসড়ক অবরোধ করে রাস্তার উপরই নবীনবরণ অনুষ্ঠান ও ওরিয়েন্টশন ক্লাস করে শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া রোববার (১০ আগস্ট) বেলা ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত দেড় ঘণ্টাব্যাপী হাটিকুমরুল গোলচত্বর এলাকায় ঢাকা-রাজশাহী, পাবনা ও রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। তারা ক্যাম্পাস নির্মাণ ও পরিবেশ উপদেষ্টা রেজওয়ানা হাসানের পদত্যাগ দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) নজরুল ইসলাম বলেন, আমাদের প্রশাসনিক কার্যক্রম চালাতে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অংশীজন ডিপিপি দ্রুত অনুমোদনের জন্য সরকারের সুনজর কামনা করছি।
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এস. এম হাসান তালুকদার বলেন, প্রকল্পটি কী কারণে একনেক সভার এজেন্ডাভুক্ত হলো না, সেটা আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। শুনেছি পরিবেশ সংক্রান্ত আপত্তি রয়েছে। চলনবিলের পানি প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রশ্ন তোলা হয়েছে। কিন্তু আমরা প্রমাণ করে দিয়েছি, চলনবিলের ৯টি উপজেলার মধ্যে শাহজাদপুর নেই। আর চলনবিলের কেন্দ্রস্থল থেকে প্রকল্প এলাকার দূরুত্ব ৬৮ কিলোমিটার। তাছাড়া প্রকল্পের প্রস্তাবিত জমি বিল শ্রেণিভুক্ত নয়। পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১৯ সালেই ছাড়পত্র দিয়েছে। সেখানে তারা ৩৩ একর জায়গা বনায়নের শর্ত দেয়। ডিপিপিতে আমরা সেটা রেখেছি।
উপাচার্য আরও বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড দুটি লেক ও তিনটি পুকুর রাখার শর্ত দিলে সেটা আমরা ডিপিপিতে রেখেছি। তারাও ছাড়পত্র দিয়েছে। ছাড়পত্র দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর আর ভূমি মন্ত্রণালয় বলেছে, এটা অকৃষি, খাস এবং পতিত জমি। এখানে ভিটেবাড়ি উচ্ছেদ করা বা জলাশয় ভরাটের প্রশ্ন আসবে না।
তিনি বলেন, তিনটি দপ্তরের শর্ত পূরণ করতে আমরা ৩৩ একর জায়গা বনায়নের জন্য, ১৬ একর লেকের জন্য, সাড়ে ৬ একর পুকুর ও ২ একর পার্কের জন্য রেখেছি। ৪১ একর জায়গা রাখা হয়েছে খেলার মাঠ, রাস্তা ও অবকাঠামোর জন্য। এর চেয়ে পরিবেশবান্ধব প্রজেক্ট আর কী হতে পারে প্রশ্ন রাখেন তিনি। পরিবেশের কথা যেটা বলা হচ্ছে সেটা উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং গ্রহণযোগ্য নয়। পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য আমরা হবো বাংলাদেশের জন্য ভ্যানগার্ড।
উপাচার্য ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, একটা ক্লাসের শেষ না হতেই আরেকটা ক্লাস করার জন্য শিক্ষার্থীদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। একটা ছোট রুমের ভেতরে ৭-৮ জন শিক্ষক থাকে। এভাবে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না। আমি বারবার বলেছি, হয় বরাদ্দ দিন নয়তো বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিন। সন্তান জন্ম দিতে পারবেন ভরণপোষণ দেবেন না এটা হয় না। একটা বিশ্ববিদ্যালয় ৮ বছর এভাবে থাকতে পারে। এর চেয়ে অমানবিক অমর্যাদকর কি হতে পারে। প্রজেক্টটা কোনো বিতর্কিত ব্যক্তির নামে নয়। একজন জাতীয় সংগীত রচিয়তা, একজন নোবেল লরিয়েটের নামে। সেই প্রকল্পের ডিপিপি ৮ বছর ধরে ঘুরছে। এমন কোনো ডিপিপি দেখান যেটা ৮ বছর ধরে পড়ে আছে?
তিনি বলেন, আগের সরকারের সময় চরমভাবে অবহেলিত ছিল রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়। সাড়ে ৭ বছরে ডিপিপি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গন্ডি পার হতে পারেনি। আমি আসার পর তিনটা স্টেজ পার করেছি। এখন ফাইনাল স্টেজে আছি। চারটা স্তর পার হতে ৮ বার সংশোধন করা হয়েছে। আর কি থাকতে পারে। প্রজেক্ট ছিল ৯ হাজার ২শ কোটি টাকা। সেখান থেকে ৯৪ শতাংশ কমিয়ে মাত্র ৬ শতাংশ করে ৫১৯ কোটি টাকায় নিয়ে এসেছি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সচিব ড. কাইয়ুম আরা বেগম বলেছেন, ইনশাল্লাহ আগামী একনেক সভায় প্রকল্পটি পাস হবে।
মন্তব্য করুন