জহুরুল ইসলাম, শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ)
প্রকাশ : ২৯ আগস্ট ২০২৫, ০৩:৪৩ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

সংকটে তাঁতশিল্প, কাজ হারিয়েছেন লক্ষাধিক

সিরাজগঞ্জের কাপড়ের হাটে নেই ক্রেতা। ছবি : কালবেলা
সিরাজগঞ্জের কাপড়ের হাটে নেই ক্রেতা। ছবি : কালবেলা

উত্তরবঙ্গের সর্ববৃহৎ কাপড়ের হাট শাহজাদপুর। মুঘল আমলে শুরু হওয়া তাঁতে কাপড় বুনন প্রসারিত হতে হতে শিল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। এই শিল্প সবচেয়ে বেশি প্রসার লাভ করে বৃহত্তর পাবনা জেলায় এবং এই শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিতি লাভ করে শাহজাদপুর। মুঘল আমলে যাত্রা শুরু করা এই শিল্পের প্রসার ঘটতে ঘটতে একবিংশ শতাব্দির শুরুর দশকে শুধু শাহজাদপুরেই হাতে চালিত তাঁতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৬২ হাজার।

কিন্তু কালের বিবর্তে বিশ্বরাজনীতি এবং বাণিজ্যিক নানা কৌশলের মারপ্যাচে হারিয়ে যেতে বসেছে তাঁত শিল্প। শাহজাদপুরের পুরো অঞ্চল খুঁজে পাওয়ারলুম এবং হ্যান্ডলুম মিলে বড়জোর টিকে আছে ৫০ হাজারের মতো তাঁত। ফলে কাজ হারিয়েছে অন্তত ১ লাখ ১২ হাজার তাঁতশ্রমিক।

শাহজাদপুর কাপড়ের হাট পরিদর্শনকালে দেশীয় তাঁতবস্ত্র উৎপাদনকারী তাঁতি ও মহাজনরা জানান, প্রতি বছরের এ সময় শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে কোটি কোটি টাকার তাঁতবস্ত্র ভারত, জার্মানি, ইতালি, ইংল্যান্ডসহ বহির্বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে রপ্তানি করা হয়। তবে মোট রপ্তানির ৪০ ভাগ তাঁতবস্ত্রই যায় পশ্চিম বাংলার উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মেদিনীপুর, হুগলি, বর্ধমান, নদীয়া, মুর্শীদাবাদ, মালদহ, জলপাইগুঁড়ি, পশ্চিম দিনাজপুর, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, কুচবিহার, হওড়া ও হুগলিসহ বিভিন্ন জেলার ছোট-বড় নামিদামি শপিংমল ও বিপণিবিতানসহ ভারতের নানা প্রদেশে।

নানা রং-বেরংয়ের বাহারী ডিজাইনের দেশি তাঁতের শাড়ির গুণগত মান ও বাজার দর ভারতীয় বস্ত্র বাজারের অনুকূলে থাকায় শারদীয় দুর্গাপূজায় দেশীয় তাঁতবস্ত্রের ব্যাপক চাহিদা বৃদ্ধি পায়। বিগত বছরগুলোতে ভারতীয় ব্যাপারী ও পাইকার একেকজন শাহজাদপুর কাপড়ের হাট থেকে এসময় কমপক্ষে ২ হাজার জোড়া থেকে ১৫ হাজার জোড়া তাঁতের শাড়ি কিনলেও তাদের আগমনের সংখ্যা প্রায় না থাকার কারণে এবার দেশীয় তাঁতবস্ত্রের শতকরা ৭০ ভাগ বিক্রি কমে গেছে।

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুসারে, দিনে দিনে দেশের তাঁতশিল্পের কেন্দ্র হিসেবে সিরাজগঞ্জ ও কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে শাহজাদপুর দেশব্যাপী ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। শাহজাদপুরের তালতলা, খঞ্জনদিয়ার, রামবাড়ি, পুকুরপাড়, মনিরামপুর, প্রাণনাথপুর, শক্তিপুর, শান্তিপুর, থানারঘাটপাড়া, আন্ধারকোঠাপাড়া, রূপপুর, রূপপুর নতুন পাড়া, দক্ষিণ পাড়া, উড়ির চর, নগরডালা, ডায়া, হামলাকোলা, জামিরতা, কৈজুরী, খুকনী, জালালপুর, পোতাজিয়া, গাড়াদহসহ নানা স্থানে তাঁতের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৬২ হাজার। শ্রমিকের সংখ্যা ছিল আনুপাতিক হারে সমান। কিন্তু পরপর কয়েকবারের বন্যা, করোনাভাইরাস, হ্যান্ডলুমের স্থলে পাওয়ারলুমের প্রচলন, এবারে দুর্গাপূজায় ভারতে দেশীয় তাঁতবস্ত্রের একটি বৃহৎ অংশ রপ্তানি করতে না পারাসহ শাহজাদপুর কাপড়ের হাটে বেচাকেনায় চরম ভাবে ধস নেমেছে। ফলে পুঁজি সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে লাখো তাঁত এবং প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন শাহজাদপুর তাঁত শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. আল মাহমুদ।

স্থানীয় তাঁতি মহাজনরা জানান, গত বছরগুলোর এ সময়ে সপ্তাহে কেবল শাহজাদপুর হাট থেকে কমপক্ষে ২শ থেকে ৪শ কোটি টাকার শাড়ি ভারতে রপ্তানি হতো। গত বছর পর্যন্ত এ চাহিদা ক্রমবর্ধমান থাকলেও এবারের চিত্র ভিন্ন। দেশীয় তাঁতবস্ত্র ব্যবসার ভরা মৌসুমেও উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহৎ শাহজাদপুর কাপড়ের হাটে দেশীয় তাঁতবস্ত্রের বেচাকেনা না থাকায় তাঁতিরা প্রতিটি মুহূর্ত চরম উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় পার করছেন।

শাহজাদপুর কাপড়ের হাটে আসা উপজেলার গাড়াদহ নতুন পাড়ার শওকত আলীর ছেলে তাঁতবস্ত্র উৎপাদক ও বিক্রেতা মাসুদ রানা জানান, তার তাঁত কারখানার ৭/৮টি তাঁতে টাঙ্গাইলের কাতান শাড়ির ত্যানা দিয়েছিলেন। ১৭শ টাকা পেটির (৪ পিস) শাড়ি উৎপাদন করে হাটে আনলেও ক্রেতা না থাকায় বিক্রি করতে পারেননি।

শাহজাদপুর কাপড়ের হাটের ইজারাদার মো. নাদিম আলী বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার ভারতে কিছুটা কম দেশীয় তাঁতবস্ত্র রপ্তানি হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে, ঐতিহ্যবাহী এ পেশাটির সঙ্গে জড়িত লাখ লাখ তাঁতির কথা মাথায় রেখে সংশ্লিষ্টরা ঐতিহ্যবাহী দেশীয় তাঁতশিল্প রক্ষায় দ্রুতই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

বাংলাদেশ স্পেশালাইজড টেক্সটাইল অ্যান্ড পাওয়ারলুম ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসটিএমপিআইএ) সহসভাপতি আবু হাসান খান মনি ও পরিচালক, কেন্দ্রীয় তাঁতি নেতা বীরমুক্তিযোদ্ধা আলহাজ হায়দায় আলী বলেন, দেশীয় তাঁতবস্ত্র ব্যবসার অন্যতম মৌসুম শারদীয় দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে স্থানীয় তাঁতিরা তাদের কারখানায় উৎপাদিত তাঁতের শাড়ি নানা কারণে ভারতে রপ্তানি করতে পারছেন না। ৩ মাস ধরে স্থলপথে ভারতে দেশীয় তাঁতবস্ত্র রপ্তানি বন্ধের কারণে শাহজাদপুর কাপড়ের হাটে তাঁতবস্ত্র বেচাকেনায় ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এ চরম দুরবস্থা থেকে উত্তরণে সরকারকেই দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে; তাহলেই ফের ঘুরে দাঁড়াতে পারবে দেশের সর্ববৃহৎ কুঁটিরশিল্প ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পীরগঞ্জে অ্যানথ্রাক্স উপসর্গের ৯ রোগী

জুলাই শহীদ কন্যা লামিয়া ধর্ষণ মামলার রায় ঘোষণা

মাদ্রাসাছাত্রের বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হলেন হুমায়ুন কবির

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে জামায়াতের সাক্ষাতের সময় পরিবর্তন

ল্যাপটপে ম্যালওয়্যার ঢুকেছে কি না চিনুন ৭ লক্ষণে

বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করবে এনসিপি

অবশেষে মেয়েকে প্রকাশ্যে আনলেন রণবীর-দীপিকা

শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বিএনপি নেতা বহিষ্কার

বিশ্বরেকর্ড গড়ল বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচ

১০

ডেঙ্গুর ছোবলে উপকূল, কিট সংকটে ঝুঁকিতে রোগীরা

১১

পাকিস্তানে ভূমিকম্প, রাতভর আতঙ্ক

১২

নির্বাচনে কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার না করার নির্দেশ সিইসির

১৩

কুমিল্লায় যুব অধিকার পরিষদের দুই নেতা গ্রেপ্তার

১৪

বাংলাদেশের কেউই যা করতে পারেননি, রিশাদ সেটি করলেন

১৫

স্কিন কেয়ারের বেসিক গাইড

১৬

সালিশেই ‘তালাক’ ও আরেক পুরুষের সঙ্গে বিয়ে

১৭

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সেনা কর্মকর্তারা আত্মসমর্পণ করেছেন : আইনজীবী

১৮

ফুটবল মাঠে বিমান বিধ্বস্ত

১৯

দেশে কত দামে স্বর্ণ বিক্রি হচ্ছে আজ

২০
X