ঋণের বোঝা যেন পাহাড় হয়ে নেমে এসেছিল মিঠুন দাসের (২৮) জীবনে। সিসি ক্যামেরা বসানোর ব্যবসা, আর ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির সামান্য চাকরি—এই দুটোর ওপরই ভরসা ছিল তার। উপার্জন যা করতেন, তার প্রায় সবই চলে যেত ঋণের সুদ পরিশোধে। দিন দিন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল তার জীবন।
একদিন বাসে যাওয়ার পথে ব্যাগ থেকে কোম্পানির প্রায় ৩ লাখ টাকা চুরি হয়ে যায়। তখন যেন আকাশ ভেঙে পড়ল মিঠুনের মাথায়। এরই মধ্যে একের পর এক ঋণের বোঝা, পরিবারের ভবিষ্যতের অন্ধকার, আর চারদিকে চাপ—সবমিলে আর সামলাতে পারলেন না তিনি। ভর সন্ধ্যায় ফেসবুকে লাইভে এসে নিজের দুঃখের কাহিনী শোনালেন। কণ্ঠ ভেঙে ভেঙে জানালেন হতাশার কথা। তারপর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন মিঠুন।
ফেসবুক লাইভে মিঠুন বলেন, কোনো দিন ভাবেননি এমন সিদ্ধান্ত নেবেন। ডিসেম্বর থেকে একের পর এক বিপদ তাকে ঘিরে ধরেছে। কোম্পানির ৩ লাখ টাকা হারিয়ে ফেলেছেন, অথচ কেউ বিশ্বাসও করবে না।
জানান, তার পরিবারকে দেখার মতো আর কেউ নেই। তবু শেষ মুহূর্তে সবার কাছে ক্ষমা চাইলেন তিনি। বললেন, সরকারের কাছে তার একটাই আবেদন—‘আমার পরিবারটাকে ঋণমুক্ত কইরেন, শেষ হতে দিয়েন না।’
রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার বনকিশোর গ্রামে মিঠুনের বাড়ি। বাবা প্রেমানন্দ দাস অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন অনেক দিন। সংসারে একমাত্র ভরসা ছিল মিঠুন। মাত্র ১৪ মাস আগে নাটোরের মেয়ে বিউটি দাসকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। কিন্তু সুখের সংসার গড়ার আগেই সব স্বপ্ন ভেঙে গেল।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে মাকে ফোন করেছিলেন মিঠুন। বলেছিলেন, ‘মা, ভালো আছো?’, মা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ভালো আছি, তুই কোথায়?’; কিন্তু কোনো উত্তর দেননি মিঠুন। হঠাৎ ফোন কেটে যায়। আর সংযোগ পাওয়া যায়নি তার সঙ্গে। রাতেই সীতাকুণ্ডে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ দেন মিঠুন। পরদিন রাত ১টা নাগাদ লাশ এসে পৌঁছায় বাড়িতে। সেই রাতেই বাড়ির পাশের বড়াল নদের তীরে দাহ করা হয় মিঠুনকে।
সম্প্রতি মিঠুনের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় মা রানীর সঙ্গে। এখনো ছেলের শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি। রানী বললেন, ‘আমার তো আর কোনো ছেইলে নাই। ওর বাপ আগে ভ্যান চালাত, এখন অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। মাথার ওপর এত ঋণ। আমার বাকি দিনটা চালাইব কে?’
মিঠুনের স্ত্রী বিউটিও নির্বাক। কথা বলতে গেলে ফেলফেল করে তাকিয়ে থাকেন। মৃদু কণ্ঠে বিউটি শুধু একবার বললেন, ‘মঙ্গলবার সে আমাকে ফোন করেছিল। বলেছিল, কাজে আছি, পরে কথা বলব। কিন্তু আর কোনো কথা হলো না।’
মিঠুনের জীবনে বিপদ ঘনিয়ে আসে গত ডিসেম্বরে। আগাম টাকা নিয়ে সিসি ক্যামেরা বসানোর অর্ডার নিয়েছিলেন। সেই টাকায় এক বন্ধুকে দিয়েছিলেন ক্যামেরা কিনতে। কিন্তু বন্ধু টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। তখন ঋণ করে ক্যামেরা কিনে দিতে হয় মিঠুনকে। দুর্ভাগ্যবশত ইনস্টলেশনের সময় ভুলে বেশি ভোল্টে সংযোগ দেওয়ায় সব ক্যামেরা পুড়ে যায়। কোম্পানি তখন ২ লাখ টাকা জরিমানা চাপায়। এভাবেই সাড়ে ৩ লাখ টাকার ঋণে ডুবে যান তিনি।
এরপর একে একে বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নেন। গয়না বন্ধক রেখে ৫০ হাজার টাকা তুলেছিলেন মা রানীও। সুদের বোঝা এত বেশি ছিল যে, প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা শুধু সুদই শোধ দিতে হতো। এর মধ্যে ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি নেন তিনি। কিন্তু সেখানকার কালেকশনের টাকা বাসে চুরি হয়ে যাওয়ার পর ভেঙে পড়েন পুরোপুরি।
শেষ পর্যন্ত জীবনের ভার আর বইতে পারলেন না মিঠুন দাস। রেখে গেলেন মায়ের বুকভাঙা কান্না, স্ত্রীর নিঃশব্দ শোক আর অসহায় পরিবারের ঋণের বোঝা।
মন্তব্য করুন