প্রাচ্যের ভেনিস বরিশাল শহরের বিনোদনকেন্দ্রগুলোর ফুডকোর্ট ও খাবারের দোকানগুলো বিগত আওয়ামী সরকারের সময় দলের স্থানীয় নেতাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। গত ১৭ বছরে গড়ে ওঠা এসব স্থাপনা থেকে তারা নিয়মিত চাঁদা আদায় করত।
সম্প্রতি বরিশাল সিটি করপোরেশন (বিসিসি) এসব দোকান ও ফুডকোর্ট উচ্ছেদ করে। এরপর বিবিসি কর্তৃপক্ষ নাগরিক সমাজের প্রশংসায় ভাসলেও নতুন করে অবৈধ এসব স্থাপনার বৈধতা দিতে তোড়জোড় শুরু করেছে তারা।
এরই মধ্যে শহরের জনপ্রিয় ভ্রমণকেন্দ্রগুলোয় প্রায় আড়াইশ অবৈধ স্থাপনাকে বৈধতা দিতে তালিকা করা হয়েছে। যাদের কাছ থেকে দৈনিক ভিত্তিতে আদায় করা হবে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা। এ খবরে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে নাগরিক সমাজের মাঝে।
বিবিসির তথ্যমতে, ৫৮ বর্গকিলোমিটারের এই সিটিতে নেই তেমন উন্মুক্ত বিনোদনকেন্দ্র। শহরের কীর্তনখোলা নদীর তীর, ঐতিহাসিক বেলস পার্ক মাঠ, চৌমাথা লেকের পাড় এবং সদর রোড বিবির পুকুর পাড় ঘিরে গড়ে উঠেছে বিনোদনকেন্দ্র। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এসব স্থানে বসে ভ্রমণপিয়াসুদের আড্ডা-ঘোরাঘুরি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের গত ১৭ বছরে এসব বিনোদনকেন্দ্রজুড়ে গড়ে ওঠে অবৈধ স্থাপনা। বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাতিজা সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ বরিশাল সিটির মেয়র থাকাবস্থায় অবৈধ স্থাপনা গড়ে ওঠে নগরজুড়ে। এ কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হয় ভ্রমণে আসা মানুষদের।
অভিযোগ রয়েছে, সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর ‘খলিফা’ হিসেবে পরিচিত নিষিদ্ধ সংগঠন মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক রইচ আহমেদ মান্না, জেলার সহসভাপতি সাজ্জাদ সেরনিয়াবাত, সাংগঠনিক সম্পাদক রাজিব হোসেন খান অবৈধ স্থাপনা ভাড়া দিয়ে প্রতি মাসে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। পরে মেয়র পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সাবেক মেয়র খোকন সেরনিয়াবাত অনুসারীদের কাছে।
এদিকে, গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরির্তনের পর স্পটগুলোয় অবৈধ দখলদারের সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। এ থেকে অবৈধ আয়ের পথে খুলে যায় একটি চক্রের। সেই পথ বন্ধ করেন বরিশাল সিটির প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার রায়হান কাওছার। তার নির্দেশে শুরু হয় উচ্ছেদ অভিযান।
সম্প্রতি বেলস পার্ক, চৌমাথা লেকের পাড় এবং সদর রোডের ঐতিহ্যবাহী বিবির পুকুর পাড় থেকে উচ্ছেদ করা হয় তিন শতাধিক অবৈধ স্থাপনা। ফলে কিছুদিনের জন্য স্থাপনগুলো তার আপন রূপ ফিরে পেলেও আবার দখল হতে শুরু করেছে। তবে এবার নগর প্রশাসনের অনুমতি নিয়েই ব্যবসা শুরু করছেন তারা।
বিসিসির হাট-বাজার শাখার তত্ত্বাবধায়ক নুরুল ইসলাম জানান, নগরীর ৩টি স্পটে কিছু সংখ্য্যক ফুডকোর্ট বা অন্য দোকান বসানোর অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে চৌমাথা লেকের পাড়ে ২৬টি, বেলস পার্ক মাঠে ১৭৪টি এবং বিবির পুকুর পাড়ে ৪০টি দোকানের তালিকা করা হয়েছে। এর মধ্যে বেলস পার্কের তালিকায় ১৭৪টি থাকলেও সেখানে সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৭০টি বসানোর অনুমতি দেওয়া হতে পারে। এরই মধ্যে অনেক স্থানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বসতে শুরু করেছে।
এই কর্মকর্তা বলেন, আগে যেমন যত্রতত্র বসত, এখন আর সেটা হবে না। এখন একটি শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসা হচ্ছে। প্রতিটি দোকানকে সিটি করপোরেশন থেকে নির্ধারিত নকশা দেওয়া হবে। ফাস্টফুডের দোকানের জন্য এক নকশা, ফুচকার দোকানের জন্য এক নকশা, চায়ের দোকানের এক নকশাসহ প্রতিটি আইটেমের ওপর আলাদা আলাদা নকশা দেওয়া হবে। নকশা অনুযায়ী দোকানগুলো তৈরি করবেন নিজ নিজ ব্যবসায়ীরা।
তিনি বলেন, নতুন করে কোনো প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। পূর্বে যারা ওইসব স্পটে ব্যবসা করেছেন, তাদেরই তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। পূর্বে এসব দোকান থেকে যারা চাঁদাবাজি করতে সেটা আর পারবে না। তবে এসব দোকান থেকে দৈনিক সর্বনিম্ন ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা করে আদায় করা হবে। যেমন ভ্রাম্যমাণ ঝালমুড়ি, বাদাম, চানাচুরের দোকান থেকে ২০ টাকা এবং অন্য আইটেম যেগুলো থাকবে, সেগুলো থেকে ৫০ টাকা করা নেওয়া হবে। মূলত রাস্তায় যারা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং নিরাপত্তাকর্মীর কাজ করছে, তাদের জন্যই সামান্য এই টাকা আদায় করা হবে বলে জানিয়েছেন বাজার তত্ত্বাবধায়ক।
তবে দোকান বসানোর আলোচনা হলেও সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত হয়নি বলে দাবি করেছেন বিসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল বারী। তিনি বলেন, যারা এরই মধ্যে উচ্ছেদ করা জায়গাগুলোয় দোকান বসিয়েছে সেগুলো আবার ধরবো, উচ্ছেদ করব।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বরিশাল জেলার সভাপতি অধ্যাপক গাজী জাহীদ কালবেলাকে বলেন, বড় বড় শহরেও এ ধরনের ফুডকোর্ট বা দোকান আছে। কিন্তু যেখানে সেখানে ব্যবসা করলে সমস্যা হয়। এদের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ব্যবসা-বাণিজ্য করার পারমিশন দিতে পারে সরকার বা প্রশাসন। সেটা করতে গিয়ে যাতে নগরবাসীকে বিড়ম্বনায় পড়তে না হয়, সেটাও দেখতে হবে। তা ছাড়া আগে অনুমোদন দিয়ে পরে আবার উচ্ছেদ, এমন দ্বিচারিতাও ঠিক নয়।
মন্তব্য করুন