ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালে প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। এ অবস্থায় ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসাসেবায় চালু করা হয়েছে ডেডিকেটেড ওয়ার্ড। বতর্মানে ওই ওয়ার্ডে ৪৯ জন রোগীর চিকিৎসা চলছে।
হাসপাতালের রেজিস্ট্রার বলছে, নগরীর বাউন্ডারিরোড হয়ে উঠেছে ডেঙ্গুর হটস্পট। এদিকে মসক নিধন ও ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় সিটি করপোরেশনের প্রতি ক্ষুব্দ নগরবাসী। মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) দুপুরে মমেক হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ড ইনচাজ ফাল্গুনী তালুকদার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১৫ জন নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন ডেঙ্গু ওয়ার্ডে। আক্রান্তদের বেশিরভাগই নগরীর নতুন বাজার এলাকা থেকে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
ডেডিকেটেড ওয়ার্ডে ভর্তি নগরীর বাউন্ডারি রোড এলাকার জামান মিয়া বলেন, সিটি করপোরেশনের ডেঙ্গু মশা নিধনের কোনো উদ্যোগ নেই। আগে আমাদের এই নগরীতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এমন কোনো নজির নেই। বর্তমানের আমিসহ আমার এলাকায় ত্রিশজনের মতো আক্রান্ত হয়েছে। আমি ষষ্ঠ তলায় বাসায় থাকি, তারপর আমার শরীরে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। তিন দিন ধরে হাসপাতালে আছি।
ডেডিকেটেড ওয়ার্ডে ভর্তি নগরীর বাউন্ডারি রোড এলাকার মাসুদ রানা বলেন, আমার শরীরে ডেঙ্গু ধরা পড়ছে আজ। ডেঙ্গুর হটস্পট এলাকা পরিণত হয়েছে নগরীর বাউন্ডারি রোড এলাকা।
নগরীর কেওয়াটখালী এলাকার আব্দুল মতিন বলেন, হঠাৎ করে শরীরে জ্বর আসে। পরে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানতে পারি ডেঙ্গু হয়েছে। আজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি।
প্লাটিলেট কমতে থাকায় সোমবার এ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন নগরীর আকুয়ার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন (২৭)। মশারির ভেতরে শুয়ে থেকে তিনি জানান, শরীরে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করেন। পরীক্ষায় ধরা পড়ে তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। তবে এখন অনেকটা ভালো বোধ করছেন।
রোগীর কথার সূত্র ধরে বাউন্ডারি রোডে গিয়ে দেখা যায়, চলছে বিভিন্ন ভবন নির্মাণকাজ। যত্রতত্র জমে আছে টলটলে পানি। এতে আশপাশের ড্রেনেজ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছে। জমে থাকা পানিতে উড়ছে মশা। এলাকাজুড়ে ড্রেনগুলোতে দেখা যায় একই চিত্র।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বর্তমানে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ৪৯ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। এরমধ্যে পুরুষ ৪৩ জন এবং নারী ৬ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ১৪ জন এবং সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ১২ জন।
হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডের বারান্দা আর ভেতরে ঢুকতেই দেখা মেলে ভয়াবহ পরিস্থিতি। ডেঙ্গু ওয়ার্ডের ২৪টি বেডের বিপরীতে চিকিৎসা নিচ্ছে ৬১ জন রোগী। এর মধ্যে গত ১৫ দিনে ময়মনসিংহ নগরীর রোগী ভর্তি হয়েছে ৪২ জন। চিকিৎসকরা বলছেন—এর বড় অংশই নগরীর বাউন্ডারি রোড, পাশের নতুনবাজার ও কলেজরোড এলাকার বাসিন্দা। যারা নিজ এলাকায় আক্রান্ত হয়েছেন।
কর্তব্যরত চিকিৎসক মেডিসিন ওয়ার্ডের কনসালটেন্ট ডা. মোস্তফা ফয়সাল রাহাত বলেন, আগে রোগী আসত জেলার বাইরে থেকে। ঢাকায় বসবাস করে ব্যবসা বা স্টুডেন্ট এমন লোক জরে আক্রান্ত হয়ে আমাদের কাছে আসত। এখন যে রোগীগুলো আসছে, সেই রোগীগুলোর কখনো ঢাকায় যাওয়ার ইতিহাসই নেই। তারা স্থানীয়, বিশেষ করে শহরের বাউন্ডারি রোড, নতুন বাজার, আকুয়া, কলেজ রোড, নাহার রোড, এই রিজনে আমরা রোগী বেশি পাচ্ছি। আক্রান্তদের বেশিরভাগ জ্বর, বমি, শরীর ব্যথা, পাতলা পায়খানাসহ নানা উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসছেন। বর্তমানে ভর্তিকৃতদের মধ্যে কোনো জটিল রোগী নেই। তবে ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। দেরি করে হাসপাতালে আসলে জটিলতা বাড়তে পারে। বর্তমানে প্রতিদিন নগরীর নতুন বাজার, বাউন্ডারি এলাকা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চার-পাঁচজন করে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।
হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন খান জানান, ডেঙ্গু রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিতের জন্য হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের চারতলায় ডেডিকেটেড ডেঙ্গু ওয়ার্ড চালুর পাশাপাশি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। ভর্তিকৃত রোগীদের সার্বক্ষণিক ফলো আপে রাখা হয়েছে। টানা কয়েকদিন জ্বর, সর্দি এবং ঠান্ডার সমস্যা হলে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন ডেঙ্গু ইউনিটের এই ফোকাল পারসন।
অন্যদিকে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ৩৩টি ওয়ার্ডে চালু করা হয়েছে ক্রাশ প্রোগ্রাম। সিটি করপোরেশন প্রাঙ্গণে এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রশাসক মো. মোখতার আহমেদ।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এইচ কে দেবনাথ বলেন, ডেঙ্গু রোগীরা ঢাকা বা অন্যান্য এলাকা থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে মেডিকেলে এসেছেন। ডেঙ্গু সচেতনতা বাড়াতে সিটি করপোরেশনের প্রত্যেক এলাকায় মাইকিং ও প্রচারণা চালানো হচ্ছে। ডেঙ্গু সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায়, মশা নিধনে ক্রাশ প্রোগ্রাম করা হয়েছে। সাধারণ মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি স্কুল-কলেজে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন এলাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত ১৫ দিনে ৪২ জন মেডিকেলে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। সারা দেশে যেভাবে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে তা মাথায় নিয়ে উড়ন্ত মশা নিধনে ক্রাশ প্রোগ্রাম হয়েছে। প্রতিদিন ৩৩টি ওয়ার্ডে সকাল-বিকেল মশা নিধনে কাজ করা হচ্ছে।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক জাকিউল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে ডেডিকেটেড ডেঙ্গু ওয়ার্ড চালু করা হয়েছে। সম্প্রতি ডেঙ্গু রোগী বেড়ে গেছে। এ ছাড়াও অক্সিজেন, স্টেরয়েড, ওষুধসহ বিভিন্ন প্রকার লজিস্টিক সাপোর্ট রাখা হয়েছে। প্রতিদিন নগরীর কোনো না কোনো এলাকা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে।
মন্তব্য করুন