শরীয়তপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৪:৩৩ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

অস্তিত্বহীন মাদ্রাসার নামে অর্ধকোটি টাকা লোপাটের প্রচেষ্টা

মাদ্রাসা বলে দাবি করা হচ্ছে যে ঘরটিকে। ছবি : কালবেলা
মাদ্রাসা বলে দাবি করা হচ্ছে যে ঘরটিকে। ছবি : কালবেলা

নেই কোনো মাদ্রাসা ভবনের অস্তিত্ব। আদৌ এখানে মাদ্রাসা ছিল কিনা সেটিও সঠিকভাবে বলতে পারছেন না স্থানীয়রা। এরপরেও ১টি গুদামঘর ও ১টি ক্লাব ঘরকে মাদ্রাসার ভবন দেখিয়ে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ প্রকল্পের ৪৬ লাখ ৭৫ হাজার ৭৫৮ টাকা আত্মসাতের চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠেছে একটি প্রভাবশালী চক্র।

ঘটনাটি ঘটেছে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার নশাসন ইউনিয়নের মাঝিরহাট এলাকায়। মাঝিরহাটে নশাসন ইবতেদায়ি মাদ্রাসা নামে কোনো মাদ্রাসার অস্তিত্ব না থাকলেও মাদ্রাসার সভাপতি দাবি করে একজন বলছেন মাদ্রাসার স্থাপনা রয়েছে। কিন্তু ওই একই কমিটির সাধারণ সম্পাদক জানিয়েছেন, মাদ্রাসার ভবন ওখানে বহু বছর আগে ছিল। এখন মাদ্রাসার কোনো ভবন নেই। অধিগ্রহণে মাদ্রাসার নামে আসা ৭ ও ৮ ধারার কোনো নোটিশ তিনি পাননি। সভাপতি তাকে এ বিষয়ে কিছুই জানাননি।

জেলা প্রশাসন ও সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবা প্রান্ত থেকে জেলা শহর পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার এলাকায় ১ হাজার ৬৮২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০৫ দশমিক ৫ হেক্টর জমি শরীয়তপুর-জাজিরা ও নাওডোবা পদ্মা ব্রিজ এপ্রোজ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। এই প্রকল্পের জন্য সড়ক বিভাগের প্রস্তাব অনুযায়ী এল এ কেস-এর মাধ্যমে জমি ও স্থাপনা অধিগ্রহণের কার্যক্রম শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসন, গণপূর্ত বিভাগ এবং বন বিভাগ যৌথ তদন্ত শেষ করে ৭ ধারার নোটিশ প্রদান করে জমি ও স্থাপনার মালিকদের। এরপর সম্প্রতি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার নশাসন গাগ্রিজোড়া ও ডিগ্রি এলাকাসহ কয়েকটি এলাকায় ৮ ধারার নোটিশ প্রদান করে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসন। প্রকল্প স্থাবর ভূমি অধিগ্রহণের আওতাভুক্ত নড়িয়া উপজেলার নশাসন ইউনিয়নের মাঝির হাট এলাকায় বিআরএস ২৩নং নশাসন মৌজার ৬নং খতিয়ানের ৩৩০৩, ৩৩০৪ ও ৩৩০৫ নম্বর দাগে ৩৪ শতাংশ জমি অস্তিত্বহীন ওই মাদ্রাসার নামে বিআরএস রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু এই রেকর্ডিয় জমি কীভাবে মাদ্রাসার নামে বিআরএস রেকর্ড হয়েছে তার কোনো দলিলাদি খুঁজে পাওয়া যায়নি। মাদ্রাসার ওই রেকর্ডীয় সম্পত্তির ৩৩০৫ নম্বর দাগসহ আরও কয়েকটি দাগের সম্পত্তি এসএ রেকর্ড অনুযায়ী পৈতৃক মালিকানা দাবি করে ২০১৯ সালে আব্দুল খালেক বেপারি জেলা প্রশাসক ও অস্তিত্বহীন মাদ্রাসাসহ পাঁচজনকে বিবাদী করে আদালতে মামলা দায়ের করে।

খালেক বেপারির মৃত্যুর পর তার স্ত্রী নিলুফা বেগম ওই মামলা এখনো পরিচালনা করছেন। জমি অধিগ্রণের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ৮ ধারার নোটিশ দেওয়ার পর মামলার বাদী আব্দুল খালেক বেপারির স্ত্রী নিলুফা বেগম গত ৩১ আগস্ট ৩৩০৫ দাগসহ মামলার আরজি অনুযায়ী আদালতে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করেন। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে বিজ্ঞ আদালত ওই মামলার পাঁচজন বিবাদীকে ১০ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করেন।

অধিগ্রহণে ৮ ধারার নোটিশে মাদ্রাসার নামে স্থাপনা হিসেবে দেখানো হয়েছে ৩৩০৫ নম্বর দাগের একটি ক্লাব ঘর। কিন্তু ওই ক্লাব ঘরটির নিজস্ব মালিকানা দলিল থাকলেও ক্লাব কর্তৃপক্ষ ৮ ধারার নোটিশ প্রাপ্ত হয়নি। ক্লাব ঘরের দক্ষিণ পাশে রয়েছে আব্দুল খালেক বেপারির একটি বাগান। তিনিও ৮ধারা নোটিশ পাননি। বাগানের পাশেই বাজারের মধ্যে জলিল মাঝির একটি গুদাম ঘর রয়েছে। ওই গুদাম ঘরটিকেও মাদ্রাসার নামে আসা ৮ ধারার নোটিশে দেখানো হয়েছে। আব্দুল জলিল মাঝির মৃত্যুর পর তার উত্তারাধিকারী স্ত্রী ফেরদৌস জাহান, মেয়ে লায়লা জিয়াসমিন ও বোন জাহানারা বেগম ৮ ধারার নোটিশ পাননি।

স্থানীয়দের দাবি, নশাসন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কামরুল আহসান মাঝি ও অস্তিত্বহীন মাদ্রাসার সভাপতি গোলাম মোস্তফা মাঝি গুদামঘরসহ ওই ক্লাব ঘরের ভবন দুইটিকে মাদ্রাসার ভবন হিসেবে দেখিয়ে সরকারি অর্থ লোপাটের চেষ্টা চালাচ্ছে। অধিগ্রহণকৃত ওই এলাকায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পূনরায় সুষ্ঠু তদন্ত করলে আরও ব্যাপক অনিয়মের চিত্র উঠে আসবে বলে মনে করছেন স্থানীয় সচেতনমহল।

স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ সরদার (৮০) বলেন, ৫০ বছর আগে এখানে কয়েকজন বাচ্চাকে মক্তবে পড়তে দেখছিলাম। কিন্তু কোনো মাদ্রাসা ছিল না। আমরা তো জানি এই জায়গাটা মৃত খালেক বেপারির।

স্থানীয় আরেক বাসিন্দা মোসলেম ঢালী (৯০) বলেন, আমার জীবদ্দশায় এখানে কোনো মাদ্রাসা দেখি নাই। এখানে মাদ্রাসার নামে ঘরের বরাদ্দ কীভাবে হলো তা সংশ্লিষ্টরাই ভালো জানেন। এখানে অতীত-বর্তমান কোনো কালেই মাদ্রাসা ছিল না।

জলিল মাঝির মেয়ে লায়লা জিয়াসমিন বলেন, নশাসন মাঝির হাট বাজারের ওই গুদাম ঘরটির মালিক আমরা। গ্রামে না থাকার কারণে ওই ঘরটি মাদ্রাসার নামে দেখানো হয়েছে। তবে কীভাবে এটা করা হয়ে তা আমি জানি না।

মামলার বাদী নিলুফা বেগম (৭০) বলেন, ৩৩০৫ নম্বর দাগের জমিতে নশাসন এবতেদায়ি মাদ্রাসা নামে মাদ্রাসার কোনো ঘর নেই। সরেজমিনে তদন্ত করলে ঘরের কোনো অস্তিত্বও খুঁজে পাবে না। ওই দাগের জায়গাটি আমার স্বামী খালেক বেপারির নামে। এই জায়গা নিয়ে এখনো আদালতে মামলা চলমান আছে। যা আমি পরিচালনা করছি।

এদিকে ৮ ধারার নোটিশ পাওয়ার ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন অস্তিত্বহীন ইবতেদায়ি সাতন্ত্র মাদ্রাসা কমিটির সাধারণ সম্পাদক চুন্নু মাঝি। তিনি বলেন, আমি স্থানীয় একটি মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক। গোলাম মোস্তফা মাঝি আমাকে ইবতেদায়ি সাতন্ত্র মাদ্রাসা কমিটির সাধারণ সম্পাদক করেছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি সভাপতি আর আমি সাধারণ সম্পাদক, এ ছাড়া এই কমিটির অন্য কোনো সদস্য আছে বলে আমার জানা নেই।

ওই ইবতেদায়ি সাতন্ত্র মাদ্রাসা কমিটির সভাপতি দাবি করেছেন গোলাম মোস্তফা মাঝি। তিনি বলেন, আমরা মাদ্রাসার ভবনের ভূমি অধিগ্রহণের ৮ ধারার নোটিশ পেয়েছি। ওই ৩টি দাগের ভূমি আমাদের মাদ্রাসার নামেই। ওই জায়গায় একটি পাকা ঘর আছে সেটিই মাদ্রাসা। ছাত্রছাত্রীরা এখন পড়তে আসে না বলে আমরা ওই পাকা ঘরটি ভাড়া দিয়ে দিয়েছি।

নশাসন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কামরুল আহসান মাঝি বলেন, ক্লাব ঘর ও গুদাম ঘর ভবনের ৮ ধারার নোটিশ মাদ্রাসার নামে হয়েছে। কীভাবে এটা হয়েছে তা মাদ্রাসার সভাপতি ভালো বলতে পারবেন। গোলাম মোস্তফা মাঝির সঙ্গে মিলে মাদ্রাসার নামে বরাদ্দকৃত টাকা বা অধিগ্রহণের সঙ্গে জড়িত কোনো বিষয়ের অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে আমি জড়িত নই। স্থানীয়দের অভিযোগ ভিত্তিহীন ও সম্পূর্ণ মিথ্যা।

বিষয়টি নিয়ে শরীয়তপুর গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মহিবুর রহমান পিইঞ্জ বলেন, জমির মালিকানা বা মূল্য নির্ধারণ করেন জেলা প্রশাসনের অধিগ্রহণ শাখা। গণপূর্তকে জেলা প্রশাসন থেকে স্থাপনার বর্ণনা দেওয়া হয়। বর্ণনা অনুযায়ী আমরা মূল্য নির্ধারণ করি। প্রত্যেকটি স্থাপনার সরেজমিন তদন্ত করা সম্ভব হয় না। কিন্তু নব্বই থেকে পঁচানব্বই ভাগ স্থাপনার সরেজিমনে তদন্ত করা হয়। জেলা প্রশাসন থেকে যদি কোনো স্থাপনার পুনঃতদন্তের জন্য বলা হয় তাহলে আমরা পুনঃতদন্ত করব।

শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, নশাসন ইবতেদায়ি সাতন্ত্র মাদ্রাসার যদি কোনো অস্তিত্ব না থাকে, তবে বিল পাবে না। রেকর্ড গ্রহণযোগ্য দলিল। মাদ্রাসার জমি নিয়ে আদালতে বিরোধপূর্ণ মামলা থাকলে মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পর প্রকৃত মালিককে স্থাপনা ও জমির ন্যায্যমূল্য প্রদান করা হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সন্ধ্যার মধ্যে ৬০ কিলোমিটার বেগে ঝড় হতে পারে যেসব অঞ্চলে

ইচ্ছাকৃতভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পিছিয়ে রাখা হয়েছিল : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

বিএনপি নেতা ফজলুর রহমানকে শোকজ

জোয়ারের তোড়ে লোকালয়ে ভেসে এলো বনের হরিণ

৩শ সাপ পুষছেন ইদ্রিস, কামড় খেয়েছেন দুই শতাধিক

রেকর্ড জয়ের পরও সিরিজ হাতছাড়া অজিদের

ভয়াবহ যৌন হয়রানির ঘটনা জানালেন সালমানের নায়িকা

‘আইন শক্তিশালী হলেই শতভাগ জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে’

দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে ইউক্রেনকে আটকে দিচ্ছে পেন্টাগন

ইসিতে ধাক্কাধাক্কি-হাতাহাতি, ক্ষোভ ঝাড়লেন রুমিন ফারহানা 

১০

গণফ্রন্টের কার্যকরী চেয়ারম্যান হয়েছেন অ্যাডভোকেট আজমল হোসেন

১১

ক্যাম্পাসে এখনো প্রান্তিক অবস্থায় ছাত্রদল, অভিযোগ আবিদের

১২

১২ মাসের জন্য ছিটকে গেলেন সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে গতিময় পেসার

১৩

তরুণ ব্যবসায়ীর লাশ নিয়ে বিক্ষোভ

১৪

আমরা চাই টাকা-পয়সার ব্যাপারে সমাধান হোক : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

১৫

বাম চোখ লাফালে কী হয়? যা বলছেন বিশেষজ্ঞ আলেম

১৬

গ্র্যান্ড স্ল্যামে প্রাইজ মানি বাড়ানোর আহ্বান জোকোভিচের

১৭

সবজির চড়া দামে বিপাকে সাধারণ মানুষ

১৮

গোবিন্দকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন রাভিনা ট্যান্ডন, দাবি সুনীতার

১৯

হঠাৎ মোবাইলের ডায়াল প্যাড পরিবর্তন হলে যা করবেন

২০
X