

বগুড়ায় হিমাগারগুলোতে লাখ লাখ বস্তা মজুk রাখা আলু নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। বাড়তি লাভের আশার এ আলুগুলো মজুk করা হলেও এবার দাম না বাড়ায় লোকসানের অজুহাতে কেউ আলু বের করছেন না হিমাগার থেকে। ফলে এই বিপুল আলু নিয়ে বিপাকে পড়েছে হিমাগার মালিকরা।
জানা গেছে, সরকার এর আগে কেজিপ্রতি আলু ২২ টাকা নির্ধারণ করলেও বাজারে সেই দাম নেই। ফলে বগুড়ার ১২ উপজেলার কৃষক ও ব্যবসায়ীরা হিমাগারে সংরক্ষিত আলু নিয়ে পড়েছেন চরম সংকটে। হিমাগারে রাখা ৬০ কেজির এক বস্তা আলুর উৎপাদন ও সংরক্ষণ খরচ যেখানে প্রায় ১ হাজার ৫০০ টাকা, সেখানে বর্তমান বাজারে প্রতি বস্তা বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৭০০-৮০০ টাকায়। এতে প্রতি বস্তায় গড়ে ৭০০ টাকার বেশি লোকসান গুনতে হচ্ছে কৃষকদের।
কৃষকরা বলছেন, বাজারে দাম না থাকায় তারা আলু বিক্রি করছেন না। এতে হিমাগারে মজুত কমছে না। গত বছর এ সময়ে হিমাগার থেকে যেখানে প্রায় ৮০ শতাংশ আলু বিক্রি হয়েছিল, এবার তা ৪০ শতাংশেরও নিচে। এতে লোকসানের পাশাপাশি নতুন করে দুশ্চিন্তায় হিমাগার মালিকরাও।
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, লোকসান কমাতে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হবেন অনেক ব্যবসায়ী।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বগুড়া জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এই জেলায় গত বছর ৫৫ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে ১১ লাখ ৯৩ হাজার ৬১৬ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে জেলার ৪২টি হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৯৪ হাজার টন আলু।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, কেজিপ্রতি আলুতে খরচ হয়েছে ২১ টাকা, বর্তমানে বিক্রি করছে মাত্র ১২ থেকে ১৫ টাকায়। এমন ক্ষতির মুখে আগামী বছর তারা আলু চাষ আর করতে পারবেন না।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে কৃষকের খরচ প্রায় ১৪ টাকা। হিমাগার ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে কেজিতে খরচ দাঁড়ায় ২৪ থেকে ২৫ টাকা। সেখানে হিমাগার ও বাজারে পাইকারিতে আলু বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১২ টাকা। কেজিতে ১০ থেকে ১২ টাকা লোকসান দিয়ে আলু বিক্রি করায় পুঁজি হারাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা জানান, আলুর দাম অনেক কম। স্টোর ভাড়া, যাতায়াত ভাড়া এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ খরচ ছাড়া ২০০ টাকাও রাখতে পারছেন না তারা। গত বছর এ সময়ে ভোক্তাদের আলু কিনতে হয়েছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে। আলুর দর বেশি পাওয়ায় এবছর প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে ২ লাখ টন আলু বেশি উৎপাদিত হয় বগুড়া জেলায়। এমন পরিস্থিতিতে হিমাগারে থাকা আলু বিক্রি হচ্ছে না এবং অনেক কৃষকের ঘরেও আলু নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে লাখ টনের বেশি আলু এখন গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের।
এদিকে হিমাগারে সংরক্ষণের সময় সীমা ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত হলেও বহু কৃষক এখনও আলু সরবরাহ নেননি। কৃষকরা বলছেন, সরকারের বেধে দেওয়া দামে আলু বিক্রি হচ্ছে না। উৎপাদন বেড়েছে, চাহিদা কমেছে। দামও নেমেছে তলানিতে। জেলার ৪২টি হিমাগারে এখন উপচে পড়ছে আলুর বস্তা। আলুর দাম কমে যাওয়ায় হিমাগারে আলু বিক্রি করতে পারছেন না কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।
শিবগঞ্জের পীরব এলাকার কৃষক আবুল কালাম জানান, হিমাগারে ১০০ বস্তা আলু রেখেছিলাম। এখন পর্যন্ত বিক্রি করে হাতে এসেছে মাত্র ২৮ হাজার টাকা। অথচ মৌসুমে বিক্রি করলে পেতাম প্রায় ৬০ হাজার টাকা।
একই উপজেলার ভরিয়া গ্রামের কৃষক ফারুক হোসেন বলেন, ৫০ বস্তা আলু রেখেছি স্থানীয় হিমাগারে। কিন্তু দাম না থাকায় বিক্রি করতে পারছি না। এখন বিক্রি করলে ২০ হাজার টাকার মতো লোকসান হবে।
শেরপুর বাজারের ব্যবসায়ী মাসুদুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, আলুর দাম বাড়লে সরকার কমাতে ব্যবস্থা নেয়। এখন দাম পড়ে গেলেও কেউ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এতে কৃষক ও ব্যবসায়ী উভয়েই সর্বনাশে পড়েছেন।
হিমাগার মালিকদের দাবি, কৃষক ও ব্যবসায়ী কেউ আলু তুলতে আসছেন না। গত বছর আগস্ট মাসেই ৫০ থেকে ৬০ হাজার বস্তা আলু হিমাগার থেকে সরানো হয়েছিল। এবার তা মাত্র ১০ থেকে ১৫ হাজার বস্তায় এসে ঠেকেছে।
বগুড়া আরবি কোল্ড স্টোরেজের স্বত্বাধিকারী পরিমল প্রসাদ রাজ জানান, আলুর দাম নিম্মমুখী হওয়ায় কৃষক, ব্যবসায়ী একং হিমাগার মালিকরা বিপাকে পড়েছেন। চাহিদা কম থাকায় সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়েও কম দামে বিক্রি হচ্ছে এসব আলু। প্রতিটি হিমাগারে শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ আলু এখানো সংরক্ষণ রয়েছে। হিমাগারে আলু সংরক্ষণের সময় সীমা ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত। তবে বৃষ্টির কারণে হয়তো আলুর চাষাবাদ পিছিয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আলু বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বগুড়া জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মমতা হক জানান, কৃষকরা আলুর ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নেবে।
বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সোহেল মো. শামছুদ্দীন ফিরোজ বলেন, চলতি মৌসুমে কিন্তু বাজারে দাম না থাকায় কৃষকরা আলু তুলতে আসছেন না। এতে আলুর বাজার ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
মন্তব্য করুন