

দেশে বর্তমান প্রেক্ষাপটে যখন শিক্ষিত বেকারত্বের হার ঊর্ধ্বমুখী ঠিক তখনি আশার আলো দেখাচ্ছেন এক তরুণ উদ্যোক্তা। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করে গতানুগতিক চাকরির পেছনে না ছুটে তিনি বেছে নিয়েছেন এক ভিন্ন পথ। মাত্র ৩ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করেন রঙিন মাছ চাষের ব্যতিক্রমী এক যাত্রা। এ উদ্যোগ এখন তার জীবনকে করেছে রঙিন। এনে দিয়েছে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও সাফল্যের স্বীকৃতি। উদ্যোক্তা হিসেবে পেয়েছেন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নানা পুরস্কার।
উদ্যোক্তা সাগর সরকারের বাড়ি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের রামজীবন ইউনিয়নের সরকারপাড়া গ্রামে। তিনি রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিসে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।
২০১৯ সালের নভেম্বরের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে একই বিষয়ের অন্য দুই বন্ধুর সঙ্গে টিউশনির ৩ হাজার টাকায় ৩৪টি মাছ নিয়ে শুরু হয় তার পথচলা। শীতকালে কিছু মাছ মারা গেলেও টিকে যায় কয়েকটি মাছ। এ অবস্থায় অপর দুই বন্ধু আশাহত হলেও নিরাশ হননি সাগর। পরে ২০২০ সাল দেশে কোভিড মহামারির কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হলে তিনি মাছের পরিচর্যায় আরো বেশি মনোযোগ দেন। এ সময়টিকে তিনি কাজে লাগান। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় আমদানি করেন মা মাছ। বাড়ির ভেতর ও বাইরের কয়েকটি চৌবাচ্চায় শুরু হয় তার চাষ। মা মাছের পোনা বিক্রি করে প্রথম দিকে লাভের মুখ না দেখলেও তার লাভ আসা শুরু হয় মূলত ২০২১ সালের দিকে। লাভের পাল্লা ভারী হওয়ায় বাড়ান মাছ চাষের পরিধি। বর্তমানে ওই চৌবাচ্চা ছাড়াও পাঁচটি পুকুরে ভেসে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন জাতের অন্তত ২ লাখ রঙিন মাছ। যার বাজার দর প্রায় ২০ লাখ টাকা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির ভেতর ও বাইরে কয়েকটি চৌবাচ্চাসহ সামনের চারটি ছোট এবং একটি বড় পুকুরে রঙিন মাছ চাষ করেছেন চাকরির পেছনে না ছোটা এ তরুণ উদ্যোক্তা। খামারের নাম দিয়েছেন ‘সাগর এগ্রো ফার্ম।’ এখন দিন কাটে তার ‘জীবন রঙিন’ করা এই রঙিন মাছের পিছনে। সকাল, দুপুর ও বিকেলে পুকুরে নিয়মিত খাদ্য দেন তিনি। সেই খাদ্য পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ভেসে আসতে থাকে হাজারো মাছ। লাল, কমলা, সাদা ও কালোসহ নানা রঙের মাছের মধ্যে রয়েছে—টাইগার বার্ব, গোরামি, অটো ব্রিড, গোল্ডফিশ, কই সফট টেল, দানিয়া, জেব্রা, অ্যাঞ্জেল থাইটার, সোর্ডটেল, গাপ্পি কমেট, সানসেট প্লাটি, রেড মলি, ব্লাক মলি, বেলুন মলি ও জাপানি বাটারফ্লাইসহ বিভিন্ন দামি মাছ।
স্বাদ অনেকটা রুই কিংবা কার্প জাতীয় মাছের মতো হলেও রঙিন এ সব মাছের দাম কেজি প্রতি প্রায় ৪ হাজার টাকা হওয়ায় কেনা সাধ্যের বাইরে সাধারণ মানুষের। আর তা খাওয়া মানেই বিলাসিতা। এগুলো মূলত বাহ্যাড়ম্বর (সামাজিক মর্যাদা) বাড়িয়ে দেয় বলে শৌখিন মানুষেরা পালন করেন বাসা-বাড়ি, ব্যাবসা-প্রতিষ্ঠান কিংবা রেস্তোরাঁর অ্যাকুয়ারিয়ামে। আর এমন শৌখিন মানুষেরা সাগরের চাষ করা এ রঙিন মাছ কেনেন সরাসরি কিংবা অনলাইনের মাধ্যমে। আকার ও রঙের ভিন্নতায় একেকটি মাছের দাম ১৫-৩০০০ টাকা। এতে প্রতি মাসে নিট লাভ হয় প্রায় ৬০-৭০ হাজার টাকা।
এই মাছ চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে জানিয়ে সাগর কালবেলাকে বলেন, দেশে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার রঙিন মাছের চাহিদা আছে। যার অর্ধেক আমদানি করা হয় বিভিন্ন দেশ থেকে। উৎপাদন বাড়াতে পারলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও আমদানি কমবে। সাশ্রয় হবে বৈদেশিক মুদ্রা।
তিনি আরও বলেন, নতুন বছরে আরও ৩টি নতুন পুকুরে মাছ চাষ করব। এতে শুধু আমার নয়, পাশাপাশি অন্যদেরও যাতে কর্মসংস্থান হয় সেই লক্ষ্য এগিয়ে যাচ্ছি।
পড়াশোনা শেষে চাকরির পিছনে না ছুটে ছেলে একজন উদ্যোক্তা হওয়ায় সাগরের বাবা মোজাফফর হোসেন খুবই খুশি এবং গর্বিত।
এদিকে, প্রয়োজনে সাগরকে মৎস্য অধিদপ্তরের আওতায় ঋণের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছেন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোছা. সুমিতা খাতুন। তিনি বলেন, ‘বাংলা মাছ বা ছোট মাছ চাষের জন্য ইতোমধ্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে সাগরকে।’
মন্তব্য করুন