

আজ ৯ ডিসেম্বর। মুসলিম নারী জাগরণের পথিকৃৎ মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যু দিবস। এই দিনে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। প্রতিবছর ডিসেম্বরের ৯ তারিখ থেকে তিনদিনব্যাপী বেগম রোকেয়া দিবস পালন করা হয় পায়রাবন্দে।
ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম নারীদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনতে যে নারী অবদান রেখেছেন, সেই নারীর জন্মভিটে এখনও অন্ধকারে নিমজ্জিত। এবার পায়রাবন্দবাসীর প্রধান দাবি—ভারতের কলকাতার সোদপুর থেকে বেগম রোকেয়ার দেহাবশেষ পায়রাবন্দে এনে সমাহিত করার। অন্য দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে—স্মৃতিকেন্দ্র চালু, দখলদারদের হাত থেকে ৫১ একর জমি উদ্ধার।
একসময় কঠোর পর্দা প্রথা, নানা কুসংস্কার এবং কূপমণ্ডূকতায় ভরা ছিল পায়রাবন্দ। মেয়েরা বন্দিজীবন কাটাতো। ধীরে ধীরে সেই অবস্থা কেটে যাচ্ছে। এখন মেয়েদের বন্দি জীবনযাপন করতে হয় না। এখানকার মেয়েরা দলবেঁধে স্কুল-কলেজে যাচ্ছে। বাল্যবিয়েও কমে গেছে। নারীরা কঠোর পরিশ্রম করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
ক্ষণজন্মা নারী বেগম রোকেয়া ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার সোদপুরে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এলাকার মানুষ তার দেহাবশেষ সেখান থেকে ফিরিয়ে আনার দাবি করেছিলেন। কিন্তু উপেক্ষিতই থেকেছে সেই দাবি। তবে এবার এই দাবি জোরালো হয়েছে। পায়রাবন্দবাসী বেগম রোকেয়ার দেহাবশেষ পায়রাবন্দে এনে সমাহিত করার জোরালো দাবি জানিয়েছেন।
স্মৃতি কেন্দ্র চালু
২০০১ সালের জুলাই মাসে পায়রাবন্দে একর ১৫ শতক জমির ওপর স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণকাজের উদ্বোধন করা হয়েছিল। নির্মাণ শেষে সেখানে ২০০৪ সালে সংগীত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। কিছুদিন পর কার্যক্রম বন্ধ হয়। এবার স্মৃতিকেন্দ্রটি চালু হচ্ছে।
বেগম রোকেয়ার জন্মভিটে পায়রাবন্দে গিয়ে দেখা গেছে, স্মৃতি কেন্দ্রটিতে রেস্টহাউস, অডিটরিয়াম, সেমিনার কক্ষ, লাইব্রেরি, গবেষণাগার, সংগ্রহশালা, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, নামাজ ঘর ও স্টাফ কোয়ার্টার রয়েছে। মূল ভবনের সামনে পিতলের তৈরি বেগম রোকেয়ার একটি ভাস্কর্য রয়েছে। স্মৃতিকেন্দ্রে ১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর এবার সেখানে কার্যক্রম শুরু হচ্ছে।
এ বিষয়ে উপপরিচালক আবিদ করিম মুন্না কালবেলাকে বলেন, ‘এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের আশা-স্মৃতিকেন্দ্রটি চালু হচ্ছে। শুরুতে ৮০ জন প্রশিক্ষণার্থী অংশ নেবেন।’
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেগম রোকেয়ার জীবন কর্ম সম্পর্কে গবেষণা, তার গ্রন্থাবলির অনুবাদ, প্রচার ও প্রকাশনা, সাংস্কৃতিক চর্চা এবং স্থানীয় যুবকদের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করার উদ্দেশ্যে এই কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীতে এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হয়নি। প্রথমদিকে স্মৃতিকেন্দ্রর দায়িত্ব ছিল বাংলা একাডেমির ওপর। ২০০৮ সালে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ওই সময় বিকেএমই’র শ্রমিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু স্মৃতিকেন্দ্রটির মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ায় স্থানীয়দের মাঝে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। পায়রাবন্দ স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল ও হিউম্যান রাইট্স অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ বিকেএমইকে উচ্ছেদের জন্য ২০১২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেন। উচ্চ আদালত স্মৃতিকেন্দ্রের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং শ্রমিক তৈরির কারখানা বন্ধের আদেশ দেন। পরে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন ২০১২ সালের ১ মে বিকেএমইকে সরিয়ে দেয়।
মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. পারভেজ কালবেলাকে বলেন, ‘বেগম রোকেয়ার জন্মভূমিকে আলোকিত করতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। তার অবদান দেশবাসীর কাছে তুলে ধরতে কাজ করে যাচ্ছে উপজেলা প্রশাসন।’
বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালে পায়রাবন্দের একটি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা জহির উদ্দিন সাবের চৌধুরী ছিলেন একজন জমিদার। জহির উদ্দিনের স্ত্রী ৪ জন। তারা হলেন-রাহাতুন্নেছা, সোনাবর, ছালেমা ও সুফিয়া। রোকেয়া ছিলেন রাহাতুন্নেছার মেয়ে। তার আরও দুই বোন ও এক ভাই ছিলেন। বোনদের নাম করিমুন্নেছা ও হুমায়রা। একমাত্র ভাই খলিলুল্লাহ্ সাবের চৌধুরী। ওই পরিবারে নারী শিক্ষা ছিল একেবারে নিষিদ্ধ। কিন্তু রোকেয়া ভাইয়ের সহযোগিতায় গোপনে শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৮৯৮ সালে ১৬ বছর বয়সে তার ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয়। বৈবাহিক জীবনে তিনি ২ সন্তানের মা হন। কিন্তু ২ সন্তানই অকালে মারা যায়।
১৯০৯ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর ভাগলপুরে একটি বালিকা বিদ্যালয়ে কাজ করেন। কিন্তু সাখাওয়াত হোসেনের প্রথম স্ত্রীর মেয়ে ও জামাতার বিরোধীতার কারণে ভাগলপুর ত্যাগ করে কলকাতায় যান। সেখানে ১৯১১ সালে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে—সুলতানার স্বপ্ন, মতিচুর, অবরোধবাসিনী, পদ্মরাগ ইত্যাদি। এর মধ্যে উপন্যাস সুলতানা’স ড্রিম জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর ‘বিশ্বস্মৃতি’ তালিকায় স্থান পেয়েছে।
মন্তব্য করুন