

‘আমি রাইখা দিলাম ডিউটি আছে, তুমি ভালো থেকো। ওই যে শেষ কথা আমার মনি (শামীম) বলে গেছে। আর কোনো কথা বলবার পারে নাই ৷ আমার ছেলে ছিল একমাত্র ঢাল! এখন সে চলে গেছে আমিও তো শেষ হয়ে গেছি।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন সুদানে সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত শান্তিরক্ষী শামীমের বাবা মো. আলমগীর ফকির।
গত শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘের একটি ঘাঁটিতে সন্ত্রাসীরা অতর্কিত ড্রোন হামলা চালালে বাংলাদেশি ছয় শান্তিরক্ষী নিহত হন। আহত হন আটজন। তারাও বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী। সবাই আবেইর জন্য জাতিসংঘের অন্তর্বর্তী নিরাপত্তা বাহিনীতে (ইউএনআইএসএফএ) কর্মরত ছিলেন। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।
এদিকে, রোববার (১৪ ডিসেম্বর) বিকেলে রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার মৃগী ইউনিয়নের হোগলাডাঙ্গি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনে বসে আহাজারি করছেন বাবা আলমগীর ফকির। স্বজন ও প্রতিবেশীরা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে শামীম সবার বড়। মেজ ভাই সোহেল ফকির সৌদি আরব প্রবাসী, সেজ ভাই সোহান বেকার অবস্থায় বাড়িতেই রয়েছেন এবং একমাত্র বোন মরিয়ম খাতুন হাফেজিয়া মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেন।
নিহত শামীমের বাবা আলমগীর ফকির কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার মনি (শামীম) এক মাস সাত দিন গেছে বিদেশে। আমার সঙ্গে শুক্রবার কথা হয়েছিল। আমি বললাম তোমার চোখমুখ ফোলা ক্যা, কইযে আমি ঘুম পারছি সেজন্য চোখ ফুলে গেছে। তারপর বলে আম্মু কই? আমি বললাম পুরান বাড়ি গেছে। একথার পরই বললো আমি রাইখা দিলাম, ডিউটি আছে। তুমি ভালো থেকো। ওই যে শেষ কথা আমার ছেলে বলে গেছে। আর কোনো কথা বলবার পারে নাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার ছেলে ছিল একমাত্র ঢাল! এখন সে চলে গেছে আমিও তো শেষ হয়ে গেছি। বিদেশে যাওয়ার দুই মাস আগে বাড়িতে এসেছিল। বাড়িতে এসে কাঁন্না করে গেছিল। এরপর আর বাড়ি আসেনি। ঐখান থেকেই চলে গেছে বিদেশে। বলেছিল আব্বু ভালো থেকো, আমি চলে যাচ্ছি। দোয়া কইরো। সরকারের কাছে আবেদন, আমার ছেলের মরদেহটা যত দ্রুত পারুক পৌঁছে দিক। এছাড়া আমার আর বলার কিছু নেই।’
আলমগীর ফকির জানান, তিনি কৃষিকাজ করে শামীমকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। ৮ বছর আগে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন শামীম। গত ৭ নভেম্বর তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সুদানে যান।
শামীমের ছোট ভাই সোহান ফকির বলেন, ‘আমার সঙ্গে বৃহস্পতিবারে শেষ কথা হয়েছে গ্রুপ কলে। আমরা তিন ভাই এবং আম্মু ছিল। আমরা কিছু কথা বলছিলাম তবে শামীম ভাইয়ের সময়ের অভাবে কথা বলতে পারি নাই। এরপর তার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি। এরপর শনিবার রাতে খবর পাই ড্রোন হামলায় সে নিহত হয়েছে। তার কাছে কিছু জিজ্ঞেস করলে সে বলতো অসম্ভব গোলাগুলি হচ্ছে। কিন্তু তাদের কোনো শঙ্কা নেই এমন কথা বলতো।’
নিহতের চাচাতো ভাই ইরান বলেন, ‘আমরা শুনেছিলাম সে আহত হয়েছে, তার পায়ে গুলি লাগছে। এরপর রাত দুইটার পরে শিওর হয়েছি যে আমার ভাইয়া মারা গেছে। আমার ভাইয়ের সঙ্গে থাকা সহকর্মী আমাদের মেসেস করছিল শামীম অসুস্থ। ওর পায়ে গুলি লাগছে। তারপর পরবর্তীতে যোগাযোগ করার পর আমরা জানতে পারি সে আর নাই।’
সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে নিহতের দাদা শবদাল হোসেন ফকির বলেন, ‘শামীমের মরদেহ যেন দ্রুত দেশে এনে আমাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।’
এ বিষয়ে কালুখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. মেজবাহ উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা এ বিষয়টি জানার পর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদেরকে কিছু আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছি৷ সন্তান হারানোর কষ্ট যে-কোনো কিছু দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। আমরা তাদেরকে কথা দিয়েছি সবসময় যোগাযোগ রাখবো। সরকারের পক্ষ থেকে আমরা তাদেরকে টেককেয়ার করবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘মরদেহের ব্যাপারে যতটুকু জানতে পেরেছি আগামী ১৭ তারিখ আসার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এখনও বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি। আশা করি খুব দ্রুত ফাইনাল তথ্য পেয়ে যাবো।’
এদিকে, গত শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) রাতে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক বার্তায় জানায়, আফ্রিকার দেশ সুদানের আবেই এলাকায় সন্ত্রাসী হামলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ছয়জন শান্তিরক্ষী নিহত এবং আরও আট জন আহত হয়েছেন। বলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে।
আইএসপিআর আরও জানায়, ওই এলাকায় পরিস্থিতি এখনও অস্থিতিশীল রয়েছে এবং সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলমান রয়েছে। আহত শান্তিরক্ষীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও উদ্ধার কার্যক্রম গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
মন্তব্য করুন