মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে চা বাগান, পাহাড়ের ঢালে সাজানো সবুজের সমারোহ দেখে চোখজুড়িয়ে যায় আমাদের। এই বাগানের পাতা থেকে তৈরি চা আমাদের ক্লান্তি দূর করে, মনে প্রশান্তি দেয়। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে একটি কুঁড়ি আর দুটি পাতা ছিঁড়ে শৌখিন মানুষের কাপে চা পৌঁছে দিচ্ছেন চা শ্রমিকরা। মাঝে পেরিয়ে গেছে অনেক সময়, ভারত ভাগ হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু চা শ্রমিকদের ভাগ্য চা বাগানের হাড়ভাঙা খাটুনির গণ্ডিতে বাধা পড়ে আছে। চা বাগানের বাজারগুলোতে ঘুরে দেখা যায় সব জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে।
চা শ্রমিক আমিন মুন্ডা বলেন, দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা, আর জিনিসপত্রের দামে বাজার আগুন হয়ে আছে, কীভাবে কি করব ঠিক মাথায় আসছে না। ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া করাব নাকি ভাত খাব আর সপ্তাহে পায় ১ হাজার ১৯০ টাকা। এই টাকা দিয়ে কীভাবে সংসার চলবে। নেই কোনো বাড়তি আয়। ঘরে আছে ৭ জন মানুষ । ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠানোর জন্য দৈনিক লাগে ৮০ টাকা। সপ্তাহে লাগে ৪৮০ টাকা। থাকছে বাকি আর ৭১০ টাকা, এইটা দিয়ে কী করি । চালের দাম ৪৮ টাকা, ১ হালি ডিম ৬০ টাকা, আলু ৭০ টাকা, পেঁয়াজ ১৩০ টাকা, তেল ২০০ টাকা, মুরগির কেজি ১৯০ টাকা। পারছি না ছেলে মেয়েদের ভালোমন্দ খাওয়াতে, পারছি না ভালো কাপড় পরাতে।
কী দিয়ে কী পান চা শ্রমিকরা
দিনে ২৪ কেজি চা-পাতা তোলেন একজন শ্রমিক। প্রতি ৪ কেজি কাঁচা চা-পাতা থেকে ১ কেজি চা হয়। তাহলে চা শ্রমিকরা দিনে ৬ কেজি চা বানানোর উপযোগী চা-পাতা তোলেন। ৬ কেজি চায়ের দাম ২৫০ টাকা কেজি হলে কমপক্ষে ১ হাজার ৫০০ টাকা। চা শ্রমিক মজুরি পান ১৭০ টাকা আর রেশন আবাসন মিলে ২১০ টাকা। কখনো এই হিসাব কি হয়েছে যে চা শ্রমিকদের মূল্য সংযোজন কত? চা উৎপাদনে খরচ কত? মালিকরা রাষ্ট্রের কাছে কী পান? তাদের জমির জন্য কত খাজনা দিতে হয়? বাগান দেখিয়ে ঋণ পাওয়ার সুবিধা কত? ১৮৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রথম চা বাগানের পর থেকে এত চা বাগান তৈরি হলো, চায়ের চাষ ছড়িয়ে গেল উত্তরবঙ্গ পর্যন্ত ,কিন্তু চা শ্রমিকদের দুঃখ দূর হচ্ছে না কেন? ১৭০ টাকায় দিন চলে না।
চা শ্রমিকরা ১৭০ টাকা মজুরি দিয়ে কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে সংসার চালান। তাদের শরীরের দিকে তাকালে জীবনযাপনের কষ্ট কেমন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। গত দুই বছরে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে শ্রমিকরা হিমশিম খাচ্ছেন। ভালো খাবার তো দূরের কথা দৈনন্দিন বাজার করাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। সন্তানদের পড়ালেখা করানোর জন্য বিভিন্নভাবে ঋণ করতে হয়। চা বাগানের চিকিৎসাব্যবস্থা খুবই খারাপ। কোনো রোগী অসুস্থ হলে অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় না।
চা বাগানে নারী শ্রমিকদের শৌচাগার নেই। এ জন্য চা বাগানের ভেতরেই শৌচকর্ম সারতে হয়। চা বাগানের নারীরা মাতৃত্বকালীন ছুটি কম পান, অন্তঃসত্ত্বা নারীরা পেটে সন্তান নিয়েও কাজ করেন। ছোট ছোট মিত্তিঙ্গা টাইপের ঘর, যার আয়তন ২১ ফুট বাই সাড়ে ১০ ফুট, সেই ঘরের ভেতর গাদাগাদি করে বসবাস তাদের। রাগে-ক্ষোভে শ্রমিকরা বলছেন কাজ করি ভালোভাবে বাঁচার জন্য।
এত কষ্ট করে কাজ করেও যদি বাঁচার মতো মজুরি না পাই তাহলে চা বাগানের কাজ করব কীভাবে? কম মজুরির প্রভাব তাদের জীবনে মারাত্মক। ২০১৯ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে দেখা যায়, অপুষ্টির কারণে চা বাগানের ৪৫ শতাংশ শিশুই খর্বকায়, ২৭ শতাংশ শীর্ণকায়, স্বল্প ওজনের শিশু ৪৭.৫ শতাংশ। ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হয়ে যায় ৪৬ শতাংশ কিশোরীর, ন্যূনতম স্যানিটেশন সুবিধা নেই চা বাগানের ৬৭ শতাংশ বাসিন্দার। তারপরও মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন চা শ্রমিকরা। কারণ যাওয়ার কোনো জায়গা যে নেই। এটাই মালিকদের জন্য সুবিধা আর শ্রমিকদের অসহায়ত্ব।
যে চা পানে আমাদের ক্লান্তি দূর হয়। সে ক্লান্ত শ্রমিকদের ক্লান্তি দূর করবে কে? পিঠে ঝোলানো ঝুড়ি, মাথায় পাতার বোঝা, ক্লান্ত শ্রমিক দাঁড়িয়ে থাকেন পাতা ওজন ঘরের কাছে। যে চা সবার ক্লান্তি দূর করে সেই চা শ্রমিক সকালে এসেছেন রুটি, বাসায় বানানো লবণ চা আর চা-পাতার ভর্তা নিয়ে, দুপুরে খাবেন বলে।
গাছের নিচে বসে কোনোমতে খেয়ে নিয়ে আবার পাতা তোলার কাজ। পুষ্টিহীন ক্লান্ত শরীর, হাত চলতে চায় না। কিন্তু ‘নিরিখ’ পূরণ করতেই হবে। বাজারে এক কেজি চাল ৪৮ টাকা, একটা ডিম ১৫ টাকা, এক কাপ লাল চা ১০ টাকা। ইচ্ছে হলেও খাওয়ার উপায় কী? অপুষ্টি আর ক্লান্তি জমতেই থাকে শরীরে দিনের পর দিন। সেটা দূরে থাক, দেশের প্রান্তিক এই মানুষগুলোর স্বাস্থ্যোজ্জ্বল চেহারা কি কখনো দেখবে না দেশের মানুষ? নাকি তারা ক্লান্ত পায়ে ক্লান্তি দূর করার চায়ের বোঝা টেনেই যাবে প্রতিদিন।
মন্তব্য করুন