সন্ধ্যা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত উপকূলীয় গ্রাম অলংকারকাঠি। পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) উপজেলার অলংকারকাঠি এখন সারা দেশে পরিচিত ফুলের জন্য। হঠাৎ দেখে মনে হবে যেন ফুলের চাদরে ঢাকা পড়েছে গ্রামটি। সারি সারি হলুদ, লাল, কমলা ও সাদা রং-বেরঙের ফুলে ফুলে ভরে আছে। নেছারাবাদের সড়ক ধরে বরিশালের দিকে যাওয়ার পথে অলংকারকাঠি বেইলি ব্রিজ পার হওয়ার পর থেকে সড়কের দুই দিকে যতদূর চোখ যায় সর্বত্রই দেখা যাবে নানা রং-বেরঙের ফুলের সমাহার। প্রায় ৭৫ বছর পূর্ব থেকে উপজেলার আকলম, অলংকারকাঠি, সুলতানপুর, সংগীতকাঠি, আরামকাঠিসহ ১০ থেকে ১২টি গ্রামে ফুলের চাষ হচ্ছে।
সরেজমিনে নার্সারিগুলো ঘুরে দেখা গেছে, অলংকারকাঠি ব্রিজ থেকে উত্তর শর্ষিনা পর্যন্ত সড়কের দু’ধারে প্রায় ৫০০ বিঘা জমিতে গড়ে ওঠা শতাধিক নার্সারিতে চারা উৎপাদনের ধুম পড়েছে। একই সঙ্গে জমে উঠেছে ফুলের চারা কেনাবেচা।
তিনটি গ্রামের অংশ বিশেষ নিয়ে ওই পল্লী গড়ে উঠলেও ইতিমধ্যে অলংকারকাঠি নামেই পরিচিতি লাভ করেছে। তিন থেকে চার সহস্রাধিক মানুষের কর্মসংস্থান করে দিয়েছে নার্সারি গ্রাম অলংকারকাঠীতে। ওই পল্লীতে সকাল-সন্ধ্যা লেগে থাকে ফুলপ্রেমী দর্শনার্থীদের ভিড়, যা একবার দেখলে বারবার ছুটে যেতে মন চায় এমন মন্তব্য করলেন নার্সারিতে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা।
নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠী) উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে স্বরূপকাঠি পৌর শহরের পাশ গ্রাম উত্তর শর্ষিনা, অলংকারকাঠি ও কৃষ্ণকাঠী গ্রামের অংশ নিয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের সড়কের দুই ধারে এসব নার্সারি অবস্থিত।
২০০২ সালে অলংকারকাঠী বেইলি ব্রিজের পশ্চিম পাড়ে কৃষ্ণকাঠী গ্রামের একখণ্ড জমি নিয়ে পানাউল্লাপুর গ্রামের মো. শাহাদাৎ হোসেন প্রতিষ্ঠা করেন বৈশাখী নার্সারি। এর কয়েক বছর পর জাহীদুল ইসলাম পলাশ প্রতিষ্ঠা করেন ছারছীনা নার্সারি। একই সময় গড়ে উঠে তৌহিদের আশা নার্সারি। এক এক করে বর্তমানে ওই সড়কের দুই কিলোমিটারের মধ্যে সড়কের দুই ধারে কহিনুর নার্সারি, আশা নার্সারি, নীরব নার্সারি, রুবেল নার্সারি, নেছারাবাদ নার্সারি, আদর্শ নার্সারি, ফারিয়া নার্সারি, সিকদার বাড়ি সততা নার্সারি, মায়ের আঁচল, শান্ত নার্সারি, কোহিনুর নার্সারি, ইয়ামিন নার্সারি, আল ফালাহ্ নার্সারি ও নেছারিয়া নার্সারিসহ নানা নামের নার্সারি।
এসব নার্সারির মধ্যে রয়েছে স্বরূপকাঠির নার্সারি জগতের পুরোধা মরহুম আব্দুল হাকিম ও মরহুম হাচেন আলীর ছেলেদের একাধিক নার্সারি। এর মধ্যে একই নামে মোট আট বিঘা জমিতে পলাশের দুটি নার্সারি রয়েছে। ওইসব নার্সারি থেকে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকার ফুলের চারা ও বিভিন্ন গাছ-গাছালির চারা দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। বিভিন্ন এলাকার শত শত মানুষ তার নিজের বা সরকারি ঠিকাদারি কাজে সরবরাহের জন্য চারা কলম কিনে নেন। শীত মৌসুম চলে শুধুই ফুলের চারা কলম।
ছারছীনা নার্সারির মালিক পলাশ ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত মেসার্স আদর্শ নার্সারীর মালিক আব্দুস ছালাম জানান, বছরে এখানের নার্সারিগুলোতে বিভিন্ন প্রজাতি ও রঙের গোলাপ ছাড়াও ডালিয়া, কেনিয়া, চন্দ্র মল্লিকা, ইনকা গান্ধা, গাদা, জিনিয়া, ফ্লকা, সালভিয়া, কেমিস্ট, স্যালোনিয়া, ডেইজি, গ্যাজোনিয়া, স্নবল, বারবিন, কেনিডোলাসহ বহু প্রজাতির ফুলের চারা পাওয়া যায়। শ্রেণিভেদে এক একটি চারার দাম ২০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। নাইট কুইনসহ আরও উন্নত জাতের ফুলের চারা পাওয়া যায় এসব নার্সারিতে। এ ছাড়া ওই সড়কের জগৎপট্টি এলাকায় রয়েছে আরও পাঁচটি নার্সারি।
নার্সারি মালিক জসিম সিকদার জানান, ঢাকার বীজ বিক্রির দোকান ও বিভিন্ন কোম্পানির এজেন্টদের কাছ থেকে বীজ কিনে আশ্বিন মাসে বীজতলা করে বীজ বপন করতে হয়। ১৫-২০ দিন পর চারা গজালে পলিথিন প্যাকেটে স্থাপন করে পানি ও ওষুধ দিতে হয়। এসব গাছে অগ্রহায়ণ মাসে ফুল আসতে শুরু করে। চৈত্র মাস পর্যন্ত ফুলের ভরা মৌসুম। ভূমি চাষ থেকে শুরু করে বিক্রি পর্যন্ত মালিক তার নিজস্ব অর্থ ব্যয়ে শ্রমিক, ওষুধ পানির ব্যবস্থা করেন। এ জন্য প্রতিটি নার্সারিতে ১০ থেকে ১৫ জন করে শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন।
পুরুষের পাশাপাশি নারী শ্রমিকরাও কাজ করেন। এ জন্য তাদের ৪০০ টাকা ও পুরুষ শ্রমিকদের ৭০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি দিতে হয়। সব নার্সারিতে মাসিক বেতনে ও বাৎসরিক কর্মচারী রয়েছে। নার্সারি মালিকরা জানান ফুলের চারা কলমের মাধ্যমে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করে নার্সারিতে সব খরচ বাদ দিয়ে ৩ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব।
এত ব্যাপক ফুলের সমাহার দেখে প্রতিটি নার্সারিতে দর্শনার্থীদের ভিড় হয়। যা সামাল দিতে মালিকদের হিমশিম খেতে হয়। অনেকে লিখে রেখেছেন এই এলাকায় প্রবেশ, ছবি তোলা বা ফুল ছেড়া নিষেধ। নিষেধাজ্ঞা থাকলেও প্রতিদিন শত শত ফুল নিয়ে যায় ও নষ্ট করে ফেলেন দর্শনার্থীরা।
নার্সারিতে কাজ করা নারী শ্রমিক নার্গিস বেগম ও মমতাজ বেগম বলেন, নার্সারিগুলোতে প্রায় শতাধিক নারী কাজ করেন। স্বামীর রোজগারের সঙ্গে তাদের আয় মিলিয়ে বেশ ভালো দিন কাটছে।
অলংকারকাঠি এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা জহিরুল হক বলেন, সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে ওই পল্লীটি একটি দর্শনীয় স্থানে পরিণত হবে। আর এ চাষের প্রসারতা বৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ীরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দাবি করেছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
নেছারাবাদ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা চপল কৃষ্ণ নাথ জানান, জেলার নেছারাবাদ উপজেলার নার্সারি শিল্প এরই মধ্যে দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে। এ শিল্পকে আরও বিকশিত করার জন্য কৃষি অধিদপ্তরে পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে। কিছু দিন আগে দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে সরকারিভাবে এখানে একটি বিশ্রামাগারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন