পেঁয়াজের ভান্ডার হিসেবে পরিচিত পদ্মাপাড়ের রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ। বিশেষ করে মুড়িকাটা পেঁয়াজ উৎপাদনে জেলার লক্ষ্যমাত্রার প্রায় অর্ধেকই গোয়ালন্দ উপজেলা উৎপাদন হয়ে থাকে। এ বছর হঠাৎ করে পেঁয়াজের আকাশচুম্বী দামের কারণে ক্ষেত থেকে অপরিপক্ব পেঁয়াজ আগাম তুলে বাজারে বিক্রি করছেন কৃষকরা। এতে ভালো দাম পেলেও উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রায় প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এদিকে ৪-৫ দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের পাইকারি দাম মণপ্রতি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ৪-৫ দিন আগেও উপজেলার বাজারগুলোতে প্রতি মণ পেঁয়াজ পাইকারি ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু বুধবার (২০ ডিসেম্বর) এই আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার টাকায় নেমে এসেছে। উপজেলার পেঁয়াজ চাষিরা হঠাৎ করেই জমি থেকে পেঁয়াজ তোলা বাড়িয়ে দেওয়ায় সরবরাহ বেড়ে যাওয়া এবং প্রশাসনের কঠোর নজরদারিতে দাম কমেছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত।
উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, পেঁয়াজের বর্তমান বাজারমূল্যের কারণে জমি থেকে অপরিপক্ব পেঁয়াজ তোলার ধুম পড়ে গেছে। তোলার পর সেই পেঁয়াজ ক্ষেতেই পরিষ্কার করা হচ্ছে। এ জন্য পরিবারের পুরুষের পাশাপাশি নারী ও শিশুরাও এ কাজে চরম ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। বিঘাপ্রতি ১৫ থেকে ২০ মণ পেঁয়াজের ফলন কম হলেও বেশি দামের আশায় চাষিরা তাদের পেঁয়াজ তুলে ফেলছেন।
উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের চর কর্নেশন গ্রামের কৃষক মিনহাজ বলেন, পরপর কয়েক বছর পেঁয়াজে লোকসান দিছি। এ বছরও ৮-৯ বিঘা পেঁয়াজের আবাদ করছি। খুব চিন্তায় ছিলাম, কী হয়? হঠাৎ পেঁয়াজের মেলা দাম হইছে দেইখা পুষ্ট হওয়ার আগেই বিক্রির জন্য তুলছি। এই দামে পেঁয়াজ বেচলে মোটামুটি লাভ হবে। তাই যত তাড়াতাড়ি পারা যায়, জমি থেকে পেঁয়াজ তুলছি।
ফকিরাবাদ গ্রামের কৃষক আরমান শেখ, জয়ধার, মানিকসহ কয়েকজন পেঁয়াজচাষি জানান, বেশ কয়েক বছর ধরে পেঁয়াজ চাষ করে তারা লোকসান দিয়ে আসছেন। গত বছর তাদের পেঁয়াজ বিক্রি শেষ হয়ে যাওয়ার পর দাম বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাই এবার দাম বেশির আশায় তারা পেঁয়াজের আবাদ করেছেন। তবে এবার বেশি দামে পেঁয়াজের বীজ কিনতে হয়েছে, এ ছাড়া সার-কীটনাশকের দাম ও কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির ফলে আবাদের খরচ হয়েছে অন্যবারের তুলনায় অনেক বেশি।
নারী কৃষক মনোয়ারা বেগম জানান, বাজারে বেশি দাম হওয়ায় আমরা পেঁয়াজ আগেই উঠাতে শুরু করেছি। যদিও এতে ফলন কম হচ্ছে। ১৫-২০দিন পর তুলদতে প্রতি বিঘা জমিতে অন্তত ১৪-১৫ মণ পেঁয়াজ বেশি উৎপাদন হতো। তারপরও পরে যদি দাম কমে যায়, সেই আশঙ্কায় তুলে ফেলছি। পেঁয়াজের সঠিক মূল্যের নিশ্চয়তা পেলে অসময়ে পেঁয়াজ উঠাতেন না বলে তিনি জানান।
ফকিরাবাদ গ্রামের কৃষক কুদ্দস ফকির জানান, তিনি এ বছর ১৪ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করেছেন। এক বিঘা জমিতে (৩৩ শতাংশ) পেঁয়াজ আবাদ করতে ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। শীত দেরিতে আসায় এ বছর পেঁয়াজের ফলনও কিছুটা কম হচ্ছে। তারপরও বিঘাপ্রতি ৪০ থেকে ৪৫ মণ পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। যদিও ১৫-২০ দিন পর এই পেঁয়াজ উঠালে এক বিঘাতে ১০-১২ মণ পেঁয়াজ বেশি হবে। তবে এমন দাম হয়তো আমরা তখন পাব না। যে কারণে অসময়ে কাঁচা পেঁয়াজ উঠাতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে গোয়ালন্দ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. খোকন উজ্জামান জানান, গোয়ালন্দ উপজেলা মুড়িকাটা পেঁয়াজের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে। কিন্তু আবাদ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০০ হেক্টর জমি। তাই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আর চাষিরা আগাম পেঁয়াজ তোলায় উৎপাদন প্রতি শতাংশে বড় জোর ২০ থেকে ২৫ কেজি পেঁয়াজ কম উৎপাদান হচ্ছে। বর্তমানে এক মণ পেঁয়াজ যে দামে বিক্রি হচ্ছে, পরে হয়তো দেড় মণ পেঁয়াজেও সেই দাম পাবেন না। তাই কৃষক আগাম পেঁয়াজ তুলে ফেলছেন। এ ছাড়া বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা ও কৃষকরা লাভবান হওয়ায় কৃষি বিভাগও কৃষকদের নিরুৎসাহিত করছে না।
তিনি আরো বলেন, আগাম মুড়িকাটা পেঁয়াজ তুলে, সেই জমিতে আবার কৃষকরা হালি পেঁয়াজের আবাদ করতে পারছেন। এতে পেঁয়াজের ঘাটতি পূরণ হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
মন্তব্য করুন