দেশের সর্ববৃহৎ একমাত্র ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ির হাট রাজধানীর ডেমরার শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর তীর ঘেঁষে বয়ে চলা ডেমরা বাজারে অবস্থিত জামদানির হাট। প্রায় সাড়ে ৩০০ বছরের পুরোনো এই হাটটি বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন হাট। এ হাটেই নাকি বিক্রি হতো মসলিন কাপড়। এখনো এ হাটটির ওপর নির্ভর করে চলছে শীতলক্ষ্যা ও বালু তীরের নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ ও সোনারগাঁও উপজেলার জামদানি শিল্প।
একটা সময় ডেমরায় জামদানি হাট বসত বৃহস্পতিবার রাত ১টা থেকে শুক্রবার কাকডাকা ভোরেই বেচাকেনা শেষ হতো। বর্তমানে প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা থেকে শুক্রবার সকাল ১০টা পর্যন্ত থাকে এই হাট বসে। ঢাকার পূর্বাঞ্চল যেমন, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ, আড়াই হাজারসহ আরও বেশকিছু এলাকা থেকে মাহাজনরা নিজের কারখানায় প্রস্তুতকৃত জামদানি শাড়ি বিক্রি করতে নিয়ে আসেন হাটে। এ ছাড়া তাঁতিরাও তাদের নিজের তৈরি শাড়ি বিক্রি করে থাকেন এ হাটে। জামদানি তৈরির কাজে জড়ির রয়েছে ১৫ শত তাঁতি আর শ’ খানেক মহাজন। সব মিলয়ে এ কাজের সাথে সরাসরি জড়িত প্রায় ৩ হাজরেরও অধিক পরিবার। জামদানি আমাদের গর্ব, আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাসের অংশ। ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম ভৌগোলিক পণ্য জামদানি শিল্প। একটা সময় ধনী পরিবারের নারীরাই জামদানি শাড়ি পড়লেও এখন মধ্যবিত্তসহ সাধারণ শ্রেণিতেও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে আমাদের দেশের হাতে তৈরি এ জামদানি শাড়ির। বেশ কদর রয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও।
হাতে বোনা প্রতি একটি শাড়ি তৈরি করতে ২ জন কারিগরের কম করে হলেও এক সপ্তাহ সময় লাগে। শাড়ি ভেদে আরও বেশি সময় লাগে। কিন্তু তাঁতিদের সংকটের কারণে আমরা চাহিদামতো উৎপাদন করতে ব্যর্থ হচ্ছে কারখানার মহাজনরা। এ সংকট বাড়তে থাকলে অল্প সময়ের মধ্যেই পিছিয়ে পড়ে শিল্পটি ঐতিহ্য হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে বলে যানান জামদানি প্রস্তুতকারী মহাজন জামদানি হাউসের স্বত্বাধিকারী মো. শাহেদ।
নারায়ণগঞ্জেরে রূপগঞ্জের নোয়াপাড়া এলাকার মহাজন জামদানি ঘরের মালিক মো. হামিদুল্লাহ কালবেলাকে বলেন, পূর্বের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী আমার তাঁতঘরে কারিগরকে প্রথমে ভরণপোষণসহ ২ বছর কাজ শেখাই। সময় শেষ হলে তখন ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে দেই শর্ত অনুযায়ী। পরে তারা স্বাধীনভাবে অন্যত্রও কাজ করতে পারে। তবে এখন তাঁতিরা তাদের ছেলেমেয়েকে কাজ শেখাতে তেমন আগ্রহ প্রকাশ করছেনা যা খুবই বিপদের কথা। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আমরা তাঁতি (কারিগর) সংকটে পড়ব। এদিকে ডেমরার ঐতিহ্যবাহী জামদানির হাটে দালালের দৌরাত্ম্য বাড়ছে বলে জিম্মি দশায় রয়েছেন হাটে আসা জামদানি ক্রেতা বিক্রেতা ও তাঁতিরা। দালালদের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক কমিশন রাখার অভিযোগ উঠেছে। তাই জামদানির হাটে দালালদের দৌরাত্ম্য জামদানি শিল্প বিকাশে একটি অন্যতম প্রতিবন্ধকতা।
একাধিক জামদানি ব্যবসায়ীরা কালবেলাকে বলেন, বর্তমানে আগের তুলনায় তাঁতিরা ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা বেতন বেশি পাচ্ছেন। যে তাঁতি আগে ১৫ হাজার টাকা বেতন পেতেন তারা এখন পাচ্ছেন কমপক্ষে মাসিক ২০ হাজার টাকা করে। তাদের সহযোগীরাও একইভাবে রোজগার বেশি করছেন। তারপরেও নতুন করে উল্লেখযোগ্য ভাবে তাঁতির সংখ্যা বাড়ানো যাচ্ছে না। শাড়ি তৈরির উপকরণ যেমন, রেশম, সিল্ক সুতা, সুতি সুতা, নায়লন সুতাসহ সমস্ত উপকরণের দাম বৃদ্ধির পরেও ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করে জামদানি শাড়ির চাহিদা বাড়লেও আমরা তাঁতি সংকটে উৎপাদন বাড়াতে পারছি না। বর্তমানে ভারতীয় জামদানি শাড়ি আমাদের দেশের বাজারে সয়লাব। মানের দিক থেকে আমাদের চাইতে খুবই খারাপ তারপরও ভারতীয় শাড়ি কম দামে পাওয়া যায় বলে আমাদের দেশি জামদানির ওপর এর প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়া একদিকে যেমন তাঁতি সংকট, আবার জামদানির হাটে গিয়ে একশ্রেণির দালালের খপ্পরে পড়ে হয়তো ক্রেতারা ঠকছে নয়তো আমরা বিক্রেতারা ঠকছি। এভাবে জামদানি শাড়ির একমাত্র হাটটি ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। তারপরে আবার ভারতীয় শাড়ির দাপট তো রয়েছেই। আমরা জামদানি শাড়ির কারিগর, তাঁতি, ব্যবসায়ী মহাজনরা পড়েছি ত্রিমুখী সমস্যায়। এসব সমস্যা থেকে মুক্তি না পেলে হয়তো জামদানি শিল্পকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। এ বিষয়ে শিল্পনগরী কর্মকর্তা (জামদানি শিল্পনগরী, বিসিক) বায়েজিদ হোসেন বলেন, ভারতীয় জামদানি আসা বন্ধ না হলে এ দেশের ঐতিহ্যবাহী জামদানি শিল্পের বড় ক্ষতি হবে। তারপরও শত বাধাবিপত্তি পেরিয়ে বর্তমানে জামদানি শিল্প এগিয়ে চলেছে। এক্ষেত্রে তাঁতি সংকট মোকাবিলায় নানা পদক্ষেপসহ আরও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশন সফল হওয়ায় প্রযুক্তিগতভাবে অনেক এগিয়েছে জামদানি শিল্প যা পর্যায়ক্রমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে আমাদের বাংলাদেশের হাতে তৈরি একমাত্র জামদানি শাড়ি।
মন্তব্য করুন