ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈলে গতবারের তুলনায় এ বছর লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে রেকর্ড পরিমাণ জমিতে সরিষা আবাদ করেছেন কৃষকরা। সরিষা চাষে দ্বিগুণ লাভের আশায় বুক বাঁধছেন উপজেলার কৃষকরা। সোমবার (২২ জানুয়ারি) উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দিগন্ত জোড়া মাঠে, মাঠে হলুদের সমারোহ। মাঠের পর মাঠ শুধু হলুদের বিশাল গালিচা, যত দূরে চোখ পড়ে শুধু হলুদ আর হলুদ। চিরসবুজের বুকে যেন কাঁচা হলুদের আলপনা।
সরিষা ফুলের হলুদ রাজ্যে এখন মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত। ফুলে ফুলে মৌমাছিরা মধু আহরণে ব্যস্ত। প্রকৃতিতে হলুদ বর্ণে শোভা পাচ্ছে বিস্তীর্ণ সরিষার মাঠ। চারদিক ছড়িয়ে পড়ছে ফুলের গন্ধের সুবাস। পরিবেশকে করে তুলেছে মোহনীয়। সেই মোহনীয় পরিবেশ ও হলদে আভার পরশ নিতে ক্ষেতে ছুটছেন প্রকৃতিপ্রেমী উৎসুক অনেকেই। সেই সঙ্গে সরিষা ফুলের ছবি তুলতে ভিড় করছেন নানা বয়সী মানুষ। কৃষকের মুখে সরিষার বাম্পার ফলনের আশায় হাসির ঝিলিক। শীতের শিশির ভেজা সকালে কুয়াশার চাদরে ঘেরা বিস্তীর্ণ প্রতিটি মাঠ যেন হলুদ বর্ণে ঘেরা এক স্বপ্নীল পৃথিবী। যেদিকে তাকাই শুধু সরিষা ফুলের হলুদ রঙের চোখ ধাঁধালো বর্ণিল সমারোহ। মৌমাছির গুনগুন শব্দে সরিষা ফুলের রেণু থেকে মধু সংগ্রহ আর প্রজাপতির এক ফুল থেকে আরেক ফুলে পদার্পণ এ অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য সত্যিই যেন মনোমুগ্ধকর এক মুহূর্ত। ভোরের বিন্দু বিন্দু শিশির আর সকালের মিষ্টি রোদ ছুঁয়ে যায় সেই ফুলগুলোকে।
আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে চলতি মৌসুমে এ উপজেলায় সরিষার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করছেন কৃষকরা। তাই তো ভালো ফলনের আশায় উপজেলার কৃষকেরা রাতদিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কৃষকের পাশাপাশি বসে নেই কৃষি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে রাণীশংকৈল উপজেলার ১টি পৌরসভাসহ ৮টি ইউনিয়নের অধিকাংশ কৃষকরা তাদের জমিতে উচ্চ ফলনশীল বারি-১৪,বারি-১৭,বারি-১৮ ও বিনা সরিষা-৯ আবাদ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখ করার মতো সরিষা আবাদ করেছেন উপজেলার অনন্তপুর গ্রামের রবিউল মানিক ১০ একর, বনগাঁও গ্রামের গয়গাম বিএসসি ১১ একর, বাচোর ইউনিয়নের সুরেন চন্দ্র ৫ একর, ধর্মগড় ইউনিয়নের আকবর আলী ১০ একর এবং কাশিপুর কাদিহাট মালশাডাঙ্গা এলাকায় কৃষি অফিসের সার্বিক তত্বাবধায়নে ১০ জন কৃষককে নিয়ে তাদের জমিতে ২৫ একর জমিতে বারি সরিষা-১৮ আবাদ করা হয়েছে।
এ মৌসুমে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৬৯৪০ হেক্টর জমি নির্ধারণ করা হয়েছে, যা গত মৌসুমে সরিষার অর্জিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬ হাজার ৫০ হেক্টর। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আশা করছে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে উপজেলায় এ মৌসুমে প্রায় ১১০৪ টন সরিষা কৃষক ঘরে তুলতে পারবে। এ ছাড়াও মৌওয়ালরা উপজেলার বিভিন্ন এলাকার সরিষা ক্ষেত থেকে প্রায় সাত শত বক্সের মাধ্যমে মণকে মণ মধু সংগ্রহ করছেন ।
এ ব্যাপারে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সাদেকুল ইসলাম বলেন, সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌমাছির চাষ হলে সরিষার ফলন প্রায় ১৫-২০ ভাগ বেড়ে যায়। এতে সরিষার ফলন ভালো হয়। এ ছাড়া সরিষা ক্ষেত থেকে বিনা খরচে মধু সংগ্রহ একটি লাভজনক ব্যবসা। এতে মৌমাছি ব্যবসায়ী যেমন একদিকে মধু বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন, অন্য দিকে ক্ষেতে মধু চাষ করায় সরিষার ফলনও বাড়ছে।
এ ব্যপারে উপজেলার নন্দুয়ার ইউনিয়নের,পয়গাম বিএসসি, বাচোর ইউনিয়নের, আবু সালেহ, লেহেম্বা ইউনিয়ের রওশন আলী, হোসেনগাঁও ইউনিয়নের আব্দুল খালেক এবং ধর্মগড় ইউনিয়নের নাসরিন বেগম বলেন, আমরা সরিষা চাষ কেরেছি, খরচ তেমন নেই। শুধু গোবর সার দিয়ে জমি চাষের পর বীজ ছিটিয়ে দিতে হয়। তারপর গাছ বড় হলে দিতে হয় সেচ। সার বা কীটনাশক তেমন একটা দিতে হয় না। এ কারণে সরিষা চাষে কম খরচে বেশি লাভ। তাছাড়া এলাকার অনেক চাষি উচ্চফলনশীল জাতের সরিষা বীজ বিনামূল্যে পেয়ে বেশ আবাদে ঝুঁকেছেন। কেমন ফলন আশা করছেন? জিজ্ঞাসা করলে মুচকি হেসে তারা বলেন, বিঘাপ্রতি ৭ থেকে ৯ মন তো হবেই ইনশাল্লাহ।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শহীদুল ইসলাম বলেন, সরকার দেশে ভোজ্য তেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে সরিষা ও তেলজাতীয় ফসল আবাদের ওপর জোর দিয়েছে। রাণীশংকৈল উপজেলায় একটি তেল জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিকরণ প্রকল্প চলমান রয়েছে। এ প্রকল্পের কার্যক্রমের কারণে উপজেলায় সরিষার আবাদ ও ফলন প্রতিবছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে উপজেলার প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কৃষককে প্রণোদনা হিসেবে বিনামূল্যে সরিষার বীজ ও সার বিতরণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে গত এক বছরেই দেড়গুণ উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি জনসংখ্যা অনুপাত হিসেবে ৪০- ৫০ ভাগ সরিষার চাহিদা পূরণ হবে । তিনি আরও বলেন, সরিষা একটি লাভজনক ঝুঁকিমুক্ত ফসল। সরিষার আবাদ বৃদ্ধিতে সরকার কৃষকদের বীজ, সার ও পরামর্শ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করছে। সরিষা চাষ সম্প্রসারণের জন্য কৃষি বিভাগ অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। আমাদের কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের যথাযথ পরামর্শ ও পরিচর্যার বিষয়ে প্রতিনিয়ত দিকনির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। আমিসহ প্রতিটি উপসহকারী কৃষি অফিসার প্রতিদিন বিভিন্ন সরিষা ক্ষেতের মাঠ পরিদর্শনে যাচ্ছি । এতে করে কৃষকরা সঠিক পরামর্শ পাচ্ছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এ বছর সরিষার বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি জানান।
মন্তব্য করুন