দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য সরকার ফ্যামিলি কার্ড করে দিয়েছেন। আর ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে ওইসব নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে কম মূল্যে পণ্য বিক্রি করছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, একজনের কার্ড দিয়ে অন্যজন পণ্য নিতে পারবেন না। কিন্তু সে নিয়ম মানা হচ্ছে না নওগাঁর বদলগাছীতে।
অভিযোগ উঠেছে, কার্ডের নাম পরিবর্তন করে অন্যজনের নাম সংযোজন, সুপারিশ ও স্বজনপ্রীতি করা হচ্ছে। এ ছাড়া কার্ড ছাড়াই ভোটার আইডির ফটোকপিতে পণ্য বিতরণ করা হচ্ছে। টিসিবির পণ্য বিতরণে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ সদর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে।
জানা যায়, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কার্ডধারী একজন সুবিধাভোগী দুই কেজি মসুর ডাল, পাঁচ কেজি চাল, দুই লিটার সয়াবিন তেল পাবেন। কিন্তু একাধিক নিম্ন আয়ের মানুষের সেই ইউনিয়ন পরিষদের টিসিবির তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত থাকার পরেও নির্দিষ্ট কার্ড না পেয়ে টিসিবির পণ্য তুলতে পারেনি। সুবিধাবঞ্চিতরা অভিযোগ করেন, ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার ও ডিলারের লোকজন যোগসাজশ করে তাদের কার্ডগুলো নিয়ে পছন্দের লোকদের দিয়ে দিচ্ছেন। ফলে তালিকায় নাম থাকার পরও পণ্য কেনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। পাচ্ছেন না কম মূল্যে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত টিসিবির পণ্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুবিধা নিচ্ছেন উচ্চবিত্ত ও সচ্ছলরা। ফলে টিসিবির তালিকায় নাম থাকার পরও পরিষদ থেকে কার্ড না পাওয়ায় এবার অনেকেই পণ্য নিতে এসে হতাশা হয়ে ফিরে গেছেন বাড়িতে।
সরেজমিনে গত দুই দিন টিসিবির পণ্য বিতরণের সময় গিয়ে দেখা যায়, বদলগাছী সদর ইউনিয়ন পরিষদে ফ্যামেলি কার্ডের বেশির ভাগ কার্ডে নেই ছবি। আবার ব্যক্তির নামের সাথে কার্ডের নামের মিল নেই। একজনের কার্ড অন্যজনকে দেওয়া হচ্ছে। আবার অনেকেই জানেন না তার নামে সরকারের দেওয়া কার্ড আছে। এ ছাড়া পণ্য নিতে আসা অনেকের হাতে রাজনৈতিক ব্যক্তির স্বাক্ষরিত সুপারিশকৃত ভোটার আইডির ফটোকপি। আবার কারও হাতে দেখা গেছে একাধিক কার্ড।
ইউপি চেয়ারম্যান, স্থানীয় মেম্বার ও চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠজন এবং রাজনৈতিক নেতারা এসব নাম পরিবর্তন করেছেন বলে অভিযোগ তোলেন টিসিবি কার্ড হাতে না পাওয়া কয়েকজন।
সদর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা জাকিয়া সুলতানা, মিলন হোসেন, আজিজুল ইসলাম, জাইদুল ইসলাম, মোহাতাব আলী, শফিকুল, শাহিন নান্নুসহ আরও অনেকেই দাঁড়িয়ে ছিলেন লাইনে। কিন্তু পরে খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে বাড়িতে। তারা জানান, ইতোপূর্বে তারা টিসিবি সুবিধা পেয়েছেন। কিন্তু এবার তাদের কার্ড নাকি বাতিল করা হয়েছে।
একই ওয়ার্ডের বাসিন্দা শাহীন বলেন, আমি কাপড় ইস্তিরি করে জীবিকা নির্বাহ করি। টিসিবি ফ্যামেলি কার্ড হওয়ার পর থেকেই আমি পণ্য পাচ্ছি। আমার কার্ড নম্বর ১৪৭০। টিসিবি পণ্য বিতরণের দিন আমার কার্ডটি পরিষদ থেকে কেউ দেয়নি। যার কারণে ওইদিন খালি হাতে ফিরে এসেছি।
একই অভিযোগের সুরে আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় আমার ১৪৭১ নম্বর কার্ডটি পরিষদ থেকে মেম্বার দেয়নি। ইতোপূর্বে টিসিবি পণ্য বিতরণের দিন আমার কার্ডটি স্থানীয় মেম্বার দিত। এবার পণ্য নিতে আসলে পরিষদ থেকে বলা হয় তোমার কার্ড নেই।
৬১২ নম্বর কার্ডধারী নান্নু হোসেন বলেন, আমি একজন ভ্যানচালক। আমার নামটা রাজনৈতিক কারণে কেটে দিয়েছে। ইতোপূর্বে আমি টিসিবির পণ্য পেয়েছি। আমার নাম কেন কাটা হলো আমি এর প্রতিবাদ জানাই। আমি গরিব মানুষ। ধনীদের নাম কাটা হয় না, আমার মতো খেঁটে খাওয়া মানুষের নাম কাটা হয়। অভিযোগ ও হতাশার সুরে বলেন তিনি।
অপরদিকে টিসিবির পণ্য নিতে লাইনে থাকা ৩নং ওয়ার্ডের দাউদপুরের সাজেদুল অন্যের কার্ড দিয়ে পণ্য তুলছেন। কার্ডের ব্যাপারে জানতে চাইলে সাজেদুল বলেন, কার্ডটি স্থানীয় ইউপি সদস্য মিজানুর তাকে দিয়েছেন।
টিসিবির ডিলার হারুন ভ্যারাইটি স্টোরের প্রোপাইটর হুমায়ুন কবির সবুজ জানান, বদলগাছী ইউনিয়ন পরিষদে ১৭৪৮টি টিসিবির ফ্যামেলি কার্ড আছে। আমাদের নির্দেশনা আছে সংশ্লিষ্ট উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের সাথে সমন্বয় করে পণ্য বিতরণের। চেয়ারম্যানরা যেভাবে বলেন আমরা সেভাবেই পণ্য বিতরণ করি।
এ ব্যাপারে বদলগাছী সদর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, আমি অসুস্থ থাকায় প্যানেল চেয়ারম্যানকে দায়িত্বটা দিয়েছি। তার সঙ্গে কথা বলতে বলেন তিনি।
জানতে চাইলে প্যানেল চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান জানান, কার্ডের নাম লিখেছে ইউনিয়ন সচিব। আমি শুধু বিতরণ করেছি। নতুন টিসিবি তালিকা অনুযায়ী নাম কার্ডে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে বলে সচিব আমাকে জানান। সুপারিশ করা ভোটার আইডি দিয়ে টিসিবি পণ্য বিতরণের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব ব্যাপারে আমি জানি না।
কার্ডের নামগুলো লেখার বিষয়টি স্বীকার করে ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আব্দুস সালাম জানান, টিসিবির তালিকা ২০১৯ সালে শুরু হয়। পরবর্তীতে চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা অনেক নাম বাদ দিয়েছে, আবার অনেক নাম নতুন করে তালিকায় দিয়েছে। আর নতুন তালিকা অনুযায়ী নামগুলো লেখা হয়েছে।
নাম পরিবর্তন, ছবি ছাড়া কার্ড ও ভোটার আইডি দিয়ে টিসিবি পণ্য বিতরণের ব্যাপারে উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা ফারুক আহম্মেদ জানান, ট্যাগ অফিসারের দায়িত্বটা ছিল উপজেলা পরিসংখ্যান অফিসারের। ওইদিন তিনি না থাকায় আমি উপস্থিত ছিলাম। নাম পরিবর্তনের ব্যাপারে আমি জানি না। আবার অনেকেই পণ্য নিতে আসে না। তাই তাদের পণ্যগুলো পরবর্তীতে উপস্থিত লোকজনদের মাঝে বিতরণ করা হয়।
এ ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী অফিসার (সহকারী কমিশনার ভূমি) আতিয়া খাতুন মোবাইল ফোনে বলেন, টিসিবি পণ্য নেওয়ার জন্য সরকার শুধু অসহায়, দরিদ্র নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ফ্যামিলি কার্ডের ব্যবস্থা করেছে। টিসিবি পণ্য বিতরণে কার্ডের নাম পরিবর্তনের বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখব। এ ছাড়া কোনো ভুক্তভোগী লিখিত অভিযোগ দিলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলেও জানান তিনি।
মন্তব্য করুন