রংপুর শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে মিঠাপুকুর উপজেলার পদাগঞ্জ বাজার। বাজারে প্রবেশ পথেই চোখে পড়বে হাঁড়িভাঙ্গা আমের ভাষ্কর্য। তিনটি আম দিয়ে তৈরি এ জায়গাটিকে বলা হয় আম চত্বর। নতুন যে কেউ জায়গাটিতে এলেই বুঝতে পারবে এটি হাঁড়িভাঙ্গা আমের জগৎ। আঁশ বিহীন অন্যন্য স্বাদের এ আম শুধু রংপুর অঞ্চল নয়, দেশ পেরিয়ে বিদেশেও বেশ নাম কুড়িয়েছে। এবার এ আম স্থান পেয়েছে জিআই পণ্যের তালিকায়। তাই আম উৎপাদন দেশ-বিদেশে রপ্তানী নিয়ে অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। রংপুর কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রংপুর জেলায় এখন ১৩ হাজার হাঁড়িভাঙ্গা আমের বাগান রয়েছে। সব থেকে বেশি আম হয় মিঠাপুকুরের খোড়াগাছ ইউনিয়নের পদাগঞ্জে। এ এলাকাটির মাটি লাল হওয়ায় আমের স্বাদও ভিন্ন। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জেলার বদরগঞ্জ উপজেলা। এরপর জেলার আরো বেশ কয়েকটি উপজেলায় এ আম চাষ করা হয়। সরেজমিনে দেখা গেছে, পদাগঞ্জের সীমানায় পৌঁছালেই চোখে পড়বে এক নতুন দৃশ্য। কোথাও কোথাও ধানি জমির আইলের চতুর্দিকে সারি করে আমগাছ লাগানো হয়েছে। পথের ধারে, বাসা-বাড়ির পরিত্যাক্ত জায়গা, বাড়ির উঠানে লাগানো আমগাছ। সব গাছেই এসেছে সোনালী মুকুল। পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছেন, গত অর্থবছরে রংপুর অঞ্চলে ২ হাজার ৫৩৭ হেক্টর জমিতে হাঁড়িভাঙা আমের আবাদ হয়েছিল। এ বছর হাঁড়িভাঙা আমের ফলন বেশি আসবে। কারণ, গত বছর যে বাগানগুলো ছোট ছিল সেগুলোর ফল ধরবে এবং আমের উৎপাদন শুরু হবে। যার কারণে গত বছরের চেয়ে এ বছরে হাঁড়িভাঙা আমের উৎপাদন বেড়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, রংপুরে হাঁড়িভাঙা আমের গাছ রয়েছে ২ হাজার ৫৩৭ হেক্টর জমিতে। যেখানে গত বছর উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ৩৫ হাজার মেট্রিক টন আম। হাঁড়িভাঙার সবচেয়ে বড় যেটা খবর সেটা হচ্ছে জিআই পণ্য হিসেবে ঘোষণা হতে যাচ্ছে এ আমের। আমের নাম হাঁড়িভাঙ্গা যেভাবে : আমের পাইকার আমজাদ হোসেন জানান, আমার বাবা নফল উদ্দিন আমের ব্যবসা করতেন। ১৯৭০ সালে ১২০ বছর বয়সে মারা যান তিনি। তিনি রংপুরের মিঠাপুকুরের বালুয়া মাসিমপুর ইউনিয়নে জমিদার রাজা তাজ বাহাদুর সিংয়ের বাড়ির বাগানে বিভিন্ন প্রজাতির সুগন্ধিযুক্ত ফুল ও সুস্বাদু ফলের বাগান থেকে একটি চারা এনে বাড়ির পাশে লাগান। তিনি বলেন, গাছটি রোপণের পর গাছের গোড়ায় পানি দেওয়ার জন্য একটা হাঁড়ি বসিয়ে তাতে ফিল্টার দিয়ে গাছে পানি দিত। কিছুদিন পর কে বা কারা সেই হাঁড়ি ভেঙ্গে দেয়। এরপর গাছ বড় হয়ে আম ধরে এবং অনেক সুস্বাদু হয়। মানুষ জানতে চাইলে বাবা বলতো এ আম হাড়ি ভাঙ্গা গাছের আম। তখন থেকেই এ আমের নাম হয় ‘হাঁড়িভাঙ্গা’। বর্তমানে এ মাতৃগাছটি মিঠাপুকুরের তেকানী মসজিদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
কীভাবে এলো এ আম : বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট (বুড়িরহাট, রংপুর) এর প্রধান বৈজ্ঞানীক কর্মকর্তা ড. আশিষ কুমার সাহা বলেন, হাঁড়িভাঙ্গার অরিজিন এখানেই (রংপুরের পদাগঞ্জ)। চাপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী বা ভারতের মালদহ জেলা এক সময় তো একই ছিল। চাপাইনবাবগঞ্জের যত আমের ভ্যারিবিলিটি আছে সব মালদহ ডিস্ট্রিকের। কিন্তু এখানে হাঁড়িভাঙ্গা আমের বহু ভ্যারিবিলিটি আছে। যেহেতু হাঁড়িভাঙ্গার অনেক ভ্যারিবিলিট আছে সুতরাং হাঁড়িভাঙ্গার অরিজিন এখানে। যেভাবে বিস্তৃতি লাভ করে এ আম : হাঁড়িভাঙা আমের সম্প্রসারক আবদুস সালাম সরকার বলেন, আমি সমবায় অফিসার ছিলাম। দশ বছর আগেই স্বেচ্ছায় অবসর নেই। ১৯৯২ সালে একদিন বিকেলে এ আম খাই, অনেক সুস্বাদু। এরপর গাছের অনুসন্ধান করি গাছের। পরে নওফেল উদ্দিন পাইকারের সেই গাছ থেকে কলাম করে অনেক কলম নিয়ে আসি। এরপর আমার দশ একর জমিতে রোপণ করি। তিনি বলেন, এ আম সম্প্রসারণ করতে এমন কোনো কাজ করিনি। গ্রামের মানুষের কাছে গেছি, ব্যবসায়ীদের বাড়িতে গেছি। ঢাকায় দুটি বিক্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। মিডিয়াকে ডেকে ডেকে নিউজ করা হয়েছে। কৃষি অফিসারকে ডেকে এ বিষয়ে অবগত করা হয়েছে। সরকারের কৃষি মন্ত্রীকে এনে আমের মেলা করেছি। পোস্টার করে পুরো জেলাতে ছাপাইছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের এমন কোনো সেনানিবাস নেই যেখানে এই আমের চারা দেওয়া হয়নি। সরকারের বড় বড় কর্মকর্তাদের এই গাছের চারা উপহার দিয়েছি। এখন পুরো বাংলাদেশ এমনকি বিশ্বের বহু দেশে যাচ্ছে এই আম। তৈরি হয়েছে মৌসুমী ব্যবসায়ী : এক সময় রংপুর অঞ্চলের মানুষ ধানের ওপর নির্ভরশীল ছিল। প্রতি মৌসুমে পাঁচ-দশ বিঘা জমি চাষাবাদ করে অতি কষ্টে জীবন চালাতেন এখানকার চাষিরা। এখন সেই জমিতে আম চাষ করে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন কৃষকরা। রংপুরের এই ‘আম অর্থনীতি’ মানুষের জীবন যাত্রা বদলে দিয়েছে।
বলা হয়ে থাকে, বর্তমানে রংপুরের নতুন অর্থকরি ফসল ‘হাঁড়িভাঙ্গা আম’ । জেলার মিঠাপুকুর, রংপুর সদর, বদরগঞ্জের বিস্তৃত এলাকার হাজার হাজার কৃষক এই আম চাষ করে নিজেদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন। পরিবারে এসেছে আর্থিক স্বচ্ছলতা। কৃষক, দিনমজুর থেকে অনেকেই হয়েছেন আমচাষি। তাই, হাঁড়িভাঙ্গা আম চাষের ওপর ঝুঁকছেন মানুুষজন। বছর বছর হাড়িভাঙ্গা আম চাষের পরিধি ক্রমান্বয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে।
তৈরি হয়েছে তরুণ উদ্যোক্তা : জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প সমিতির রংপুর জেলা কমিটির সভাপতি মো. রাকিবুল হাসান রাকিব বলেন, আমার জানাশুনার মধ্যে রংপুরের দুই শতাধিক তরুণ উদ্যোক্তা রয়েছে যারা এই আম দেশের ভিন্নি অঞ্চলে অনলাইনে অফলাইনে বিক্রি করেন। এরা মৌসুমী ব্যবসায়ী। এদের মধ্যে কেউ শিক্ষার্থী, কেউ অন্য ব্যবসা করেন। প্রতি বছরই নতুন উদ্যাক্তা তৈরি হচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো খবর বা আশার দিক।
রংপুর চেম্বারের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোস্তফা সোহরাব চৌধুরী বলেন, হাঁড়িভাঙ্গার কারণে যে উদ্যাক্তা তৈরি হচ্ছে তা আশাব্যঞ্জক। আমি জানি অনেকে এই ব্যবসা করেন।
বিশ্ব দুয়ারে রংপুর : রংপুরের বিখ্যাত এই আম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য হাঁড়িভাঙা জাতের আম পাঠিয়েছেন। এই আম খেয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী বেশ প্রশাংসা করেছিলেন বলে গণমাধ্যমে সংবাদ বেড়িয়েছিল। এ ছাড়াও প্রতি বছর মালয়েশিয়া, সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানী হয়ে আসছে এই আম।
রপ্তানীর টার্গেট : রংপুর কৃষি বিপনন অধিদপ্তরের সিনিয়ার কৃষি বিপনন কর্মকর্তা (দায়িত্ব প্রাপ্ত) শাহীন আহমেদ বলেন, প্রতি বছরই আমরা বিদেশে এই আম রপ্তানী করছি। এ বছরও আমাদের রপ্তানীর টার্গেট আছে।
অর্থনীতিতে অবদান : রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোরশেদ হোসেন বলেন, রংপুর অঞ্চলের টেকসই উন্নয়নে এই আম অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। হাঁড়িভাঙ্গা আম রংপুরের অর্থনীতিতে অনেক পরিবর্তন এনেছে। অনেক বছর ধরে শত শত কোটি টাকার আম বিক্রি করছেন চাষিরা। এই টাকা রংপুরের অর্থনীতিতে বেশ প্রভাব রাখছে।
তিনি বলেন, আমাদের সৈয়দপুর বিমানবন্দর রয়েছে, চিলমারী নৌবন্দর রয়েছে। আমরা যদি সেভেন সিস্টার বলে যে দেশগুলো আছে সেগুলোতেও রপ্তানী করতে পারি তাহলে অনেক আয় অর্জণ সম্ভব।
মন্তব্য করুন