‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে’ রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আকাশ ছুঁই ছুঁই সারি সারি তালগাছের সেদৃশ্য এখন আর গ্রামবাংলায় তেমন চোখে পড়ে না।
বরেন্দ্র অঞ্চলে চৈত্র ও বৈশাখ মাসে যেন রুক্ষ হয়ে ওঠে প্রকৃতি। এরই মধ্যে রুক্ষ ভূমিতে প্রশান্তি ও শোভা বর্ধনকারী হয়ে উঠেছে তালগাছগুলো। খরতাপ ও বজ্রপাত সহনীয় পর্যায়ে রাখতে নওগাঁর নিয়ামতপুরের বিভিন্ন সড়কে লাগানো হয়েছে তালগাছ। স্থানীয় এরকম একটি সড়ক তালসড়ক হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছে মানুষের মাঝে। তালগাছ শুধু যে উচ্চতায় সব গাছকে ছাড়িয়ে যায়, বিষয়টি এমন নয়। এ ছাড়াও বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গেও তালগাছ জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে।
আশির দশকে তালগাছের পাতা দিয়ে তালপাখার বাতাস না হলে মন জুড়াত না। বর্তমানে এসবের ব্যবহার কমেছে। কিন্তু আজও তালের পিঠা, গুড়ের পায়েস কিংবা তালের রুটি না খেলে বাঙালির মন জুড়ায় না। আর বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে তালগাছের তো কোনো বিকল্পই নেই। তাই বিভিন্ন সড়কের পাশে, বাড়ির পাশে, জমির ধারে লাগানো হচ্ছে তালগাছ।
সবুজ মাঠের বুক চিরে নিয়ামতপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে হাজিনগর ইউনিয়নের ছোট্ট একটি গ্রাম ঘুঘুডাঙ্গা। মজুমদার মোড় থেকে ঘুঘুডাঙ্গা গ্রাম পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তার দুই ধারে প্রায় ৬০০টি তালগাছ দাঁড়িয়ে আছে। বৃক্ষপ্রেমী ও ভ্রমণপিয়াসীরা আসেন ঘুঘুডাঙ্গা তালসড়কে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে প্রকৃতি। আকাশে মেঘ জমলে মানুষ আতঙ্ক হয়ে পড়ে। উঁচু গাছ না থাকায় বজ্রপাতে মানুষের প্রায় মৃত্যু হচ্ছে। পরিবেশ থেকে তালগাছ হারিয়ে যাওয়ায় এ বজ্রপাত বেড়ে গিয়ে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন, মাটির ক্ষয়রোধ, অনাবৃষ্টি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে তালগাছ রোপণের গুরুত্ব অপরিসীম। সাধারণত বজ্রপাত বেশি আঘাতহানে উঁচু গাছে। এ দিক থেকে তালগাছ বজ্রপাতের ঝুঁকি কমায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নিয়ামতপুর হাজিনগর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান এবং বর্তমান নওগাঁ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নওগাঁ-১ আসনের সংসদ সদস্য সাধন চন্দ্র মজুমদার ১৯৮৩ সালে পরিষদের দায়িত্ব পালনকালে হাজিনগরের মজুমদার মোড় থেকে ঘুঘুডাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তার দুই ধারে প্রায় ৭০০টি তাল বীজ রোপণ করেন। বেশ কিছু গাছ বিভিন্নভাবে মারা গেলেও এখনো প্রায় ছয়শ তালগাছ বেঁচে আছে। সংসদ সদস্য সাধন চন্দ্র মজুমদারের রোপিত সেই তালগাছগুলো বর্তমানে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ সেই তালগাছগুলো বর্তমানে ৫০ থেকে ৬০ ফিট লম্বা হয়ে কালের সাক্ষী হয়ে রাস্তার দুই ধারে শোভাবর্ধন করে আসছে। এই তালগাছগুলো প্রতিদিন দেখতে অনেক দর্শক ও বৃক্ষপ্রেমীরা দেখতে আসেন।
স্থানীয় সূত্রে ও বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) সূত্রে জানা যায়, বরেন্দ্র অঞ্চলে তালগাছসহ অন্যান্য বড় বড় গাছ হারিয়ে যাওয়ায় বজ্রপাত বেড়ে গিয়েছে। বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা মাঠে-ঘাটে কাজ করতে গিয়ে মারাও যাচ্ছেন।
উপজেলার হাজিনগর ইউনিয়নের ঘুঘুডাঙ্গা গ্রামের ফারুক বলেন, গত কয়েক বছর থেকে এ সড়কটি তালতলি হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। দূর-দুরান্ত থেকে মানুষ প্রতিদিনই দেখতে আসছে। তালতলিতে অস্থায়ীভাবে কয়েকটি দোকান হওয়ায় বেশ কয়েকজনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
বৃক্ষপ্রেমী মোস্তাকিন হোসেন বলেন, ফেসবুক ও ইন্টারনেটে এ জায়গাটির কথা শুনেছি। তবে কখনো আসা হয়নি। সময় করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ছুটে আসা। জায়গাটি অনেক সুন্দর।
হাজিনগর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তাল গাছের ছায়ায় এক অন্যরকম প্রশান্তি অনুভব করি। সড়কের দুই পাশে দেখা মিলবে সবুজের ফসলের ক্ষেত। এটি একদিকে যেমন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করছে অন্যদিকে এ জায়গাটি পর্যটকদের কাছে এখন বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে পরিণত হয়েছে।
উপজেলা চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ বলেন, গ্রামে এখন তেমন তালগাছ দেখা যায় না। এখানে একসঙ্গে অসংখ্য তালগাছ এবং নির্মল পরিবেশ দেখে সত্যি মুগ্ধ হয়। তালগাছ শুধু সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য নয়, এখন প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
মন্তব্য করুন