প্রতারণার মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া রাজশাহীর গ্রিন প্লাজা রিয়েল এস্টেট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান ‘ভুয়া’ আপসনামা দেখিয়ে আদালতে জামিন নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। মামলার বাদী এজাজুল হক এ দাবি করেছেন। তিনি বিষয়টি আদালতের নজরে আনবেন বলেও জানিয়েছেন। এজাজুল হকের বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায়।
এজাজুল হক গত ২১ মার্চ ভোররাতে মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে নগরীর বোয়ালিয়া থানায় একটি মামলা করেন। মামলার অভিযোগে তিনি বলেন, মোস্তাফিজুরের কাছ থেকে একটি ফ্ল্যাট নিতে তিনি ১২ লাখ টাকা দেন। কিন্তু তিনি চুক্তিপত্রের শর্ত ভেঙে ফ্ল্যাটটি অন্যজনের কাছে বিক্রি করে দেন। এ কারণে এজাজুল টাকা ফেরত চাইলে তা দিতে অস্বীকার করেন মোস্তাফিজুর। এর পরই মোস্তাফিজুরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
সেই দিন সকালেই তাকে থানা থেকে আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বিকেলে রাজশাহী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-১ এ মোস্তাফিজুর রহমানের আইনজীবী শফিকুল ইসলাম তার জামিন আবেদন করেন। এ সময় বিচারক মহিদুল ইসলাম আসামির জামিন মঞ্জুর করেন। এ দিন স্বাধীনতা দিবসের ছুটি থাকার কারণে আদালতের কর্মচারীরা ছিলেন না। দায়িত্বে থাকা পুলিশ এই মামলার নথিপত্র আদালতের কাছে উপস্থাপন করে।
আসামির জামিন পাওয়ার কথা শুনে অবাক হন বাদী এজাজুল হক। বুধবার (২৭ মার্চ) বিকেলে তিনি রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) আদালত পরিদর্শকের কার্যালয় থেকে মামলার নথিপত্র তুলে দেখেন, আসামিপক্ষ একটি আপসনামা জমা দিয়েছে। যাতে স্বাক্ষর রয়েছে ২০২৩ সালের ৭ নভেম্বরের।
আপসনামাটিতে উল্লেখ আছে, ‘ফ্ল্যাটের ক্রেতা এজাজুল হক চুক্তি বাতিল করছেন। চুক্তিপত্র অনুযায়ী মোস্তাফিজুর রহমান ১০ শতাংশ টাকা কেটে বাকি ১০ লাখ ৮০ হাজার টাকা পরিশোধ করলেন। এজাজুলের আর কোনো দাবি থাকল না।’
এ বিষয়ে এজাজুল হক বলেন, তিনি এক টাকাও ফেরত পাননি। কোনো আপসনামাও হয়নি। মামলার নথিতে থাকা এই আপসনামাটি ভুয়া। সেখানে থাকা তার স্বাক্ষরটি জাল। তিনি বলেন, ‘আমার নামে ভুয়া আপসনামা আদালতে দেওয়ার কারণে আমি মামলা করব।’
এজাজুল হক আরও বলেন, আসামি মোস্তাফিজুরের আইনজীবী শফিকুল ইসলাম তার পূর্বপরিচিত। মোস্তাফিজুরকে আদালতে নেওয়ার পর তিনি আপস করার জন্য কয়েকদফা ফোন করেন। আইনজীবী শফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথোপকথনের অডিও রেকর্ডও এজাজুল হক শোনান। এতে শফিকুল ইসলামকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি থাকলে তোমার টাকা তো পাবাই। ১২ লাখ টাকায় তুমি কোটিপতি হয়ে যাবা? মানুষের মানসম্মান আছে না?’ এজাজুল বলেন, ‘এই প্রতারকের জন্য আপনি অনুরোধ করছেন কেন?’
একপর্যায়ে আইনজীবী শফিকুল ইসলাম বাদী এজাজুল হককে বলেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। তোমাকে আমি আর অনুরোধ করব না। তুমি চুপ থাকো। তুমি এই মামলাতে পারলে জেল দিও।’
ভুয়া আপসনামা দিয়ে আসামির জামিন করানোর অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আইনজীবী শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আপসনামা আমি দেব কেন? আমার মক্কেল দিয়েছে। আসল না নকল সেটা সে বলতে পারবে। আমি বলতে পারব না।’ জামিন শুনানির আগে বাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করে আপসের জন্য চাপ দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
আদালতে নথিপত্র উপস্থাপন করেছিলেন আরএমপির আদালত পরিদর্শকের কার্যালয়ের (জিআরও) বোয়ালিয়া ও মতিহার থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপপরিদর্শক (এসআই) মাহমুদুল হাসান। আপসনামাটি দেখে তিনি বলেন, ‘এই আপসনামা আসামি মোস্তাফিজুরের আইনজীবী দিয়েছেন।’
আপসনামাটি জাল, বাদীর এমন দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা তো আমি বলতে পারব না। এ রকম হয়ে থাকলে বাদী বিষয়টি আদালতের নজরে আনবেন।’ তিনি জানান, ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে হাজির হওয়ার শর্তে আসামিকে জামিন দিয়েছেন আদালত।
রাজশাহী জেলা জজ আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী পারভেজ তৌফিক জাহেদী জানান, মামলাটি পেনাল কোডের ৪২০, ৪০৬ ও ৫০৬ ধারায় করা হয়েছে। এই তিন ধারার মধ্যে ৪০৬ ধারাটি অজামিনযোগ্য। তবে বাদীর সঙ্গে আসামির আপস হলে আদালত জামিন কিংবা মামলা নিষ্পত্তি করতে পারেন। আপসনামাটির কারণেই আসামি জামিন পেয়েছেন। এটি ভুয়া হলে মামলার পরবর্তী ধার্য তারিখে বাদী বিষয়টি আদালতের নজরে আনতে পারেন।
জানা গেছে, মোস্তাফিজুর রহমান রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক পরিচালক। বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট। ২০১০ সালের দিকে রাজশাহীতে পলিটেকনিকে ভর্তি হয়ে পড়াশোনার খরচ চালাতে তিনি এক নিঃসন্তান দম্পতির বাসায় পালক ছেলে হিসেবে আশ্রয় নেন। ২০১৯ সালে তিনি ডেভেলপার ব্যবসায় নাম লেখান। এখন তিনি দামি হ্যারিয়ার গাড়িতে চড়েন। ফ্ল্যাট বিক্রির নামে তার বিরুদ্ধে বহু মানুষের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে।
তার বিরুদ্ধে প্রথম মামলাটি করেন এজাজুল হক। পরে মঙ্গলবার (২৬ মার্চ) দিনগত রাতে নগরীর চন্দ্রিমা থানায় তার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়েছে। এই মামলার বাদীর নাম মো. রুবেল। ফ্ল্যাট বিক্রির নামে মোস্তাফিজুর তার কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। বিষয়গুলো নিয়ে মামলার আসামি মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে বুধবার সন্ধ্যায় তাকে ফোন করা হয়। তবে তার মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
উল্লেখ্য, মাত্র ১০-১২ বছর আগেও রাজশাহীর একটি বেসরকারি কোম্পানির অফিস সহকারী ছিলেন মোস্তাফিজ। পড়াশোনার খরচ জোগাতে প্রয়াত এক ব্যাংক কর্মকর্তার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ওই ব্যাংক কর্মকর্তাকে বাবা এবং তার স্ত্রী নাসরিন সুলতানাকে মা পাতিয়েছিলেন মোস্তাফিজ। তাদের নিকট থেকেও প্রতারণা করে ৯০ লাখ টাকা এবং ৩ কাঠার একটি জমি আবাসন ব্যবসার নাম করে নেন মোস্তাফিজ। এরপর থেকে মোস্তাফিজের উত্থান শুরু হয় রাজশাহী নগরীতে।
একের পর এক প্রতারণা করে মাত্র পাঁচ-সাত বছরের মাথায় সেই প্রতারক মোস্তাফিজ যান কোটিপতি বনে। আর এই প্রতারণার মাধ্যমে অবৈধ অর্থ উপার্জন করে অল্প সময়েই ফুটপাত থেকে পৌঁছে যান রাজপ্রাসাদে। চড়েন বিলাসবহুল গাড়িতে। যাপন করেন আভিজাত্যপূর্ণ চাকচিক্যময় চোখ ধাঁধানো জীবন। বাগিয়ে নিয়েছিলেন রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের মতো প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের পদও।
এই প্রতারককে নিয়ে গত শনিবার (২৩ মার্চ) ‘প্রতারণা করে ফুটপাত থেকে রাজপ্রাসাদ’ শিরোনামে কালবেলায় একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। একই শিরোনামে কালবেলার মাল্টিমিডিয়াতেও মোস্তাফিজের প্রতারণার বিষয়টি উঠে আসে। চাঞ্চল্যকর এই খবর প্রকাশিত হলে রাজশাহীতে সৃষ্টি হয় ব্যাপক তোলপাড়। এরপরই এই প্রতারকের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা মামলা করে।
মন্তব্য করুন