কক্সবাজারের উখিয়ায় পাহাড় কাটা ঠেকাতে গিয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার বন কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামানের মা উম্মে কুলসুম ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী। প্রতিমাসে ছেলের দেওয়া টাকায় চিকিৎসা হতো তার। রোববার (৩১ মার্চ) ছেলের মৃত্যুর খবরের পর থেকে সাজ্জাদুজ্জামানের মা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। জ্ঞান ফিরলেই কান্নাকাটি করছেন। মাকে রেখে কেন সাজ্জাদুজ্জামানকে আল্লাহ নিয়ে গেলেন, এগুলো বলে বিলাপ করছেন তিনি।
সাজ্জাদুজ্জামান আড়াই বছর আগে নারায়ণগঞ্জের মুমতাহেনা সুমিকে বিয়ে করেন। তাদের ঘরে মাবির শাহ নামে ৯ মাস বয়সী শিশু সন্তান রয়েছে। স্বামী সাজ্জাদের মৃত্যুর পর থেকে অনেকটাই বাকরুদ্ধ সুমি আক্তার। তিনি কারও সঙ্গে কথা বলছে না, সামনেও আসছেন না।
সোমবার (১ মার্চ) দুপুরে সাজ্জাদুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার ভবেরচর ইউনিয়নের ভিটিকান্দি গ্রামে গিয়ে এ করুণ দৃশ্য দেখা গেছে।
সাজ্জাদুজ্জামান কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের উখিয়া রেঞ্জের দোছড়ি বনবিটের দায়িত্বে ছিলেন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বন বিভাগে যোগদান করেন তিনি। সাজ্জাদ মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার ভবেরচর ইউনিয়নের ভিটিকান্দি এলাকার মোহাম্মদ শাহজাহানের ছেলে।
সাজ্জাদুজ্জামানের বাড়িতে কথা হয় তার বাবা মো. শাহজাহানের সঙ্গে।
তিনি কালবেলাকে বলেন, রমজান মাসে প্রতি রাতে সেহরির সময় আমাকে ফোন করত। ওর মা আর আমার সঙ্গে অনেক সময় নিয়ে কথা বলত। পরিবার ও তার মায়ের চিকিৎসার খরচ চালাতো সে। সব শেষ শুক্রবার কথা হয়েছিল তার সঙ্গে। মায়ের চিকিৎসার কথা বলেছিলাম।
তিনি বলেন, সে বলেছিল কোনো চিন্তা যেন না করি। মাস শেষে বেতন পাওয়া মাত্র টাকা পাঠিয়ে দেবে। শনিবার (৩০ মার্চ) আর কথা হলো না। সেদিন সেহরির সময় ফোন এলো ঠিকই। সে ফোনে জানানো হলো সাজ্জাদুজ্জামান আর নেই। তাকে মাটিখেকোরা হত্যা করেছে।
সাজ্জাদের ভাই কামরুজ্জামান কাজল কালবেলাকে বলেন, সাজ্জাদুজ্জামান আমার চেয়ে তিন বছরের ছোট। সংসারের প্রতি খুব দায়িত্বশীল ছিল। ছোট থেকেই পরোপকারী ছিল সে। অন্যায় মেনে নিতে পারত না। বিপদে কেউ ডাকলে রাত হলেও সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যেত। এদেশে আইন আছে, তার পরেও বন, পাহাড় উজার হচ্ছে। আইন, আইনের মত থাকছে। প্রভাবশালীরা বন উজার করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ঘটনার দিন সে পাহাড় কাটার খবর শুনে মোটরসাইকেল সহকর্মীসহ ঘটনাস্থলে যান। ফোর্সসহ যাওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু সাজ্জাদ বলেছিল আগে গিয়ে পরিস্থিতি দেখবে, পরে প্রয়োজন মোতাবেক ব্যবস্থা নেবে।
কামরুজ্জামান বলেন, ডাম্পারচালক দূর থেকে তাদের আসতে দেখেছিল। সে দুজনকে হত্যা করার জন্য মোটরসাইকেলর ওপরে ডাম্পারটি উঠিয়ে দিয়ে সাজ্জাদ হত্যা করল।
তিনি আরও বলেন, আমরা সাজ্জাদকে আর ফিরে পাব না। সে তার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে। আমরা সাজ্জাদুজ্জামানের হত্যার বিচার চাই। আমার ভাইয়ের বাচ্চার জীবন এখন কীভাবে চলবে। যদি ওর স্ত্রীর জন্য বন বিভাগে একটি চাকরির ব্যবস্থা করা হতো তাহলে হয়তো ওদের জীবনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়টা ঠেকানো যাবে।
বনকর্মীরা জানান, ডাম্পারটি (ট্রাক) হরিণমারা এলাকার ছৈয়দ করিমের। বাপ্পি নামের এক যুবক সেটি চালাচ্ছিলেন। হত্যার জন্যই তাদেরকে ডাম্পার চাপা দেওয়া হয়।
রোববার (৩১ মার্চ) জোহর নামাজের পর কক্সবাজার শহরে বিভাগীয় বন বিভাগের কার্যালয় প্রাঙ্গণে সাজ্জাদুজ্জামানের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর স্বজনেরা মরদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় আসে। রাতে জানাজা শেষে দাফন করা হয় তাকে।
এর আগে শনিবার (৩০ মার্চ) দিবাগত রাতে হরিণমারায় পাহাড় কেটে বালু পাচার হচ্ছিল। এমন খবর পেয়ে সাজ্জাদুজ্জামান বন বিভাগের গাড়িচালক মো. আলীকে নিয়ে বাইকে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। এ সময় বালু পাচারকারীরা ডাম্পার দিয়ে মোটরসাইকেল আরোহী সাজ্জাদ ও আলীকে হত্যার জন্য চাপা দিয়ে পালিয়ে যান। এতে ঘটনাস্থলে মারা যান সাজ্জাদুজ্জামান। আহত অবস্থায় চালক আলীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়।
মন্তব্য করুন