দুয়ারে কড়া নাড়ছে পবিত্র ঈদুল ফিতর ও পহেলা বৈশাখ। বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) দেশে উদযাপিত হবে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় এই উৎসব। ঈদ উপলক্ষে বরাবরের মতো এবার বেশ কয়েকদিনের জন্য ছুটি পাচ্ছেন সবাই। এবার ঈদের ছুটির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে পহেলা বৈশাখের ছুটিও। তাই টানা ছুটিতে ঘুরে আসার জন্য ভ্রমণপিপাসুরা বেছে নিতে পারেন কুমিল্লার যে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো।
শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতির পাদপীঠ হিসেবে পরিচিত কুমিল্লা জেলায় রয়েছে বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক নিদর্শন ও দর্শনীয় স্থান। এসব ঐতিহাসিক স্থান দেখতে যতটা সুন্দর তার সঙ্গে রয়েছে অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। বিশেষ করে সপ্তম থেকে অষ্টম শতাব্দীর বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের আশ্রয়স্থল বলা হয় কুমিল্লাকে। একসময় এই জেলা সমতট জনপদের অংশ ছিল। কালক্রমে এটি ত্রিপুরা রাজ্যভুক্ত হয়। কুমিল্লা নামটি এসেছে কমলাঙ্ক শব্দ থেকে, যার অর্থ পদ্মের পুকুর।
ইট-পাথরের দেয়ালে ঘেরা আমাদের শহুরে জীবন। নানা কর্মব্যস্ততার ফলে দিন দিন মানুষ যান্ত্রিক মানব হিসেবে সমাজে বেড়ে উঠছে। সময় হয়ে উঠে না কোথাও বেরিয়ে আসার। মানসিক প্রশান্তি পেতে হলে প্রত্যেকের জন্য ভ্রমণ হয়ে ওঠে একটি ওষুধ। অতিরিক্ত কর্ম ব্যস্ততার চাপকে সরিয়ে বিষণ্নতা দূর করতে ভ্রমণের বিকল্প নেই। মানসিক প্রশান্তি পেতে ঘুরে আসতে পারেন কুমিল্লার কয়েকটি দর্শনীয় স্থান।
নব শালবন বিহার
কুমিল্লার প্রাচীন নিদর্শনের এক নতুন সংযোজন কোটবাড়ি এলাকার এই বিহার। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের শান্তি বিহার নামে পরিচিত বিহারটি প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৯৫ সাল। এখানকার মূল আকর্ষণ আপাদমস্তক ধাতুতে মোড়া প্রায় ছয় টন ওজনের ৩০ ফুট উচ্চতার সোনালি রঙের বুদ্ধের মূর্তি। ২০১৪ সালে থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ ধর্মীয় ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এটি বাংলাদেশকে উপহার দেওয়া হয়।
ময়নামতি জাদুঘর
কুমিল্লার ঐতিহাসিক নিদর্শনের এক গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহশালা এই ময়নামতি জাদুঘর। এটি নব শালবনের পাশেই সালমানপুরে অবস্থিত। জাদুঘরের ৪২টি ভিন্ন ভিন্ন সংরক্ষণাগার ঘুরে দেখার সময় চোখে পড়বে ব্রোঞ্জ ও পাথরের ছোট-বড় মূর্তি, স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, ব্রোঞ্জের বিশাল ঘণ্টা, পোড়ামাটির ফলক, মাটির খেলনা, কাঠের পুরোনো জিনিসপত্র, মৃৎশিল্প সামগ্রী এবং প্রাচীনহাতে লেখা পান্ডুলিপিসহ প্রাচীন জিনিসপত্র।
কুমিল্লার চারপত্র, ইটাখোলা, রূপবান ও কোটিলা মুড়া, শ্রীভবদের মহাবিহার, রানির বাংলা ও ভোজ রাজবাড়ী বিহার এবং আনন্দ বিহার খননকালে খুঁজে পাওয়া যায় এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো। জাদুঘরের বিশ্রামাগার আর ফুল বাগান সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। দেশি-বিদেশি ফুলের সৌন্দর্য যা ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়। ১৯৬৫ সালে কোটবাড়ির শালবন বিহারের পাশেই স্থাপন করা হয় এই জাদুঘর। পাশাপাশি হওয়ায় এক সঙ্গে দুটো স্থানই ঘুরে আসতে পারেন পর্যটকরা।
রূপবান মুড়া
কুমিল্লার যত প্রত্নতত্ত্ব রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম রূপবান মুড়া। তবে লোকমুখে খুব একটা প্রচলন না থাকায় এ প্রত্নতত্ত্বটির সন্ধান অনেক ভ্রমণপ্রিয় পর্যটকের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেনি। কুমিল্লা-কালীর বাজার সড়কের দক্ষিণে পল্লী উন্নয়ন একাডেমির পাশেই একটি টিলার ওপর এ মুড়া অবস্থিত। পাহাড়ে ওঠার মতোই উঁচু পথ পাড়ি দিয়ে উঠতে হয় রূপবান মুড়াতে। খনন কাজের পর এখানে মাঝারি আকারের প্রায় ক্রুশ আকৃতির একটি সমাধি মন্দির আবিষ্কৃত হয়েছে। এর সঙ্গে আরও পাওয়া গেছে অষ্টাকোণাকৃতি স্তূপ এবং বর্গাকৃতির ভিতের ওপর আর একটি স্তূপসহ বেশসংখ্যক সাহায্য কাঠামোসমূহ।
আয়তাকার স্তূপ অঙ্গনের মধ্যে প্রাচীর দেয়াল এগুলোকে বেষ্টন করে রেখেছে। প্রথানুযায়ী পূর্বদিকে প্রবেশপথ আছে এবং এর সম্মুখে আছে মঠের প্রবেশদ্বার। গভীর খননকার্যের ফলে দেখা যায়, এর নির্মাণ, সংস্কার ও পুনঃনির্মাণের তিনটি স্তর আছে। প্রাচীনতম স্তরটি নির্মাণ করা হয়েছিল ছয় থেকে সাত শতকের মধ্যে।
ইটাখোলা মুড়া
জেলার আরেকটি দর্শণীয় স্থান ইটাখোলা মুড়া। এটি কোটবাড়ি সড়কের একটু সামনে গেলে রূপবান মুড়ার উল্টো দিকে অবস্থিত। অনেকেই মনে করেন, প্রাচীনকালে এ স্থানটি ইট পোড়ানোর খনি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আর এজন্যই স্থানটির নাম ইটা খোলা মুড়া করা হয়েছে।
লতিকোট মুড়া
স্থানীয়ভাবে এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাটি লতিকোট মুড়া নামে পরিচিত। কিন্তু খনেনর ফলে এখানে ৩৩টি ভিক্ষুকক্ষ বিশিষ্ট একটি বৌদ্ধ বিহারের নকশা উন্মোচিত হয়। ফলে এটিকে বর্তমানে লতিকোট বিহার নামে অভিহিত করা হয়। বিহারটিতে দুটি নির্মাণ যুগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় নির্মাণ যুগে একটি মণ্ডপ নির্মাণ করা হয়েছিল। বিহারে প্রবেশের প্রধান তোরণ উত্তর দিকে ছিল। দর্শনীয় স্থানটি দেখতে এখানে অনেকেই ছুটে আসেন।
আনন্দ বিহার
কোটবাড়ির ময়নামতিতে অবস্থিত স্থাপনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় এই বিহারটি ছিল উপমহাদেশের সর্বশেষ বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়। এটি নির্মাণ করেছিলেন দেব রাজবংশের তৃতীয় শাসক শ্রী আনন্দ দেব। সপ্তম অথবা অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দিকে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ধারণা করা হয়, সপ্তম শতকের শেষ সময়ে এই বিহার ছিল সমতটের রাজধানী। নান্দনিক বর্গাকৃতির বিশাল অবকাঠামোর ঠিক মধ্যখানে রয়েছে কেন্দ্রীয় মন্দির এবং অপরূপ এক দিঘি।
বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড)
গাছ-গাছালি ও ফুল বাগানে সুসজ্জিত কোটবাড়ির এই স্থাপনাটি মূলত একটি স্বায়ত্তশাসিত গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান। ১৯৫৯ সালের ২৭ মে প্রতিষ্ঠার সময় এটির নাম ছিল পাকিস্তান গ্রাম উন্নয়ন একাডেমি। পরবর্তীতে পল্লী গবেষক ড. আখতার হামিদ খান এটিকে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি নাম দেন। সংক্ষেপে যেটি বার্ড নামে সুপরিচিতি লাভ করে।
প্রায় ১৫৬ একরের সুবিশাল জায়গায় রয়েছে পাঁচটি হোস্টেল, হেলথ ক্লিনিক, চারটি কনফারেন্স রুম, মসজিদ, স্পোর্টস কমপ্লেক্স, লাইব্রেরি, একটি প্রাইমারি স্কুল ও দুটি ক্যাফেটেরিয়া। বিশেষ অনুমতি নিয়ে এখানে পিকনিক করার সু-ব্যবস্থা আছে। প্রকৃতির চাদরে ঘেরা এ স্থানে গেলে ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের মন জুড়িয়ে যায়।
ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শহীদ হওয়া ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার সৈনিকদের একটি আন্তর্জাতিক সমাধিক্ষেত্র এই ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি। ২৪ জন জাপানি যুদ্ধবন্দি ও একজন বেসামরিক ব্যক্তিসহ মোট ৭৩৭ জন সৈন্যের কবর আছে এই সমাধিক্ষেত্রে। কমনওয়েলথ পরিচালিত ওয়ার সিমেট্রিটির অবস্থান ময়নামতি সাহেব বাজার এবং কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের টিপরা বাজারের মধ্যস্থলে। প্রায় ৪ দশমিক ৫ একর পাহাড়ি ভূমির ওপর গড়ে তোলা ওয়ার সিমেট্রি বাংলাদেশের দ্বিতীয় কমনওয়েলথ সমাধিক্ষেত্র। স্থানীয়দের কাছে ইংরেজ কবরস্থান নামে পরিচিত।
ধর্মসাগর দীঘি
কুমিল্লা সদরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ধর্মসাগর দীঘি। দীঘির পাড়ে গেলে একটি সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে এর ইতিহাস। ত্রিপুরার রাজা ধর্মমাণিক্য শাসনামলে রাজ্যে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তখন তিনি তার প্রজাদের কষ্ট দূর করতে খনন করেন ধর্মসাগর দীঘিটি। তার নামানুসারেই দীঘিটি প্রসিদ্ধি লাভ করে। দীঘির উত্তরে সবুজে ঘেরা শিশুপার্ক থেকে ধর্মসাগরের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করা যায়। পর্যটকরা ধর্মসাগরের পাড় ধরে হেঁটে বেড়ান, কেউবা নৌকা নিয়ে ভেসে বেড়ান দীঘির জলে। ছোট ছোট ঢেউ থামছে পাড়ে এসে। হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে মৃদুমন্দ বাতাস। উত্তালতা নেই। নেই পানির গর্জন। আছে বিশালতা। সমুদ্রের মতো দিগন্তছোঁয়া না হলেও সেই বিশালতা স্থান-পাত্রভেদে সাগরের মতই পর্যটকদের প্রাণ জুড়াবে।
রানি ময়নামতির প্রাসাদ
কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক ধরে পূর্বদিকে কমনওয়েলথের ওয়ার সিমেট্রি থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার গেলেই দেখা যাবে এই প্রাসাদ। এই পুরাকীর্তিটির নির্মাণকাল অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর কোনো সময়। সে সময় চন্দ্র বংশের রাজা মানিক চন্দ্র তার স্ত্রী ময়নামতির আরাম আয়েশের জন্য বানিয়ে দেন প্রাসাদটি। ১৯৮৮ সালে খননের সময় আবিষ্কৃত হয় এই প্রাসাদ। প্রতি বৈশাখের সপ্তম দিন থেকে এখানে মাসব্যাপী উদযাপন হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বৈশাখী মেলা।
এ ছাড়া ভ্রমণপিপাসুরা লালমাই পাহাড়, ব্লু ওয়াটারপার্ক, ফান টাউন, ম্যাজিক প্যারাডাইস, রাজেশপুর ইকোপার্ক, লালমাই লেকল্যান্ডও ঘুরে আসতে পারেন। ফেরার সময় নিতে পারেন নগরীর কান্দিরপাড় মনোহরপুরে অবস্থিত কুমিল্লার বিখ্যাত মাতৃভান্ডারের রসমালাই।
কীভাবে যাবেন
দর্শনীয় এ স্থানগুলোতে যেতে হলে দেশের যে কোনো জায়গা থেকে বাস অথবা ট্রেনে এসে নামতে হবে কুমিল্লা শহরে কিংবা কোটবাড়ি বিশ্বরোড। ঢাকা থেকে বাসে আসলে নামতে হবে কোটবাড়ি বিশ্বরোড। এই যাত্রায় সময় নিবে মাত্র আড়াই ঘণ্টা। সেখান থেকে সিএনজি বা অটোরিকশাযোগে যেতে পারবেন কোটবাড়ির রূপবান মুড়া, লতিকোট মুড়া, ইটাখোলা মুড়া এবং ময়নামতি বৌদ্ধ বিহার, জাদুঘর।
কোটবাড়ি বিশ্বরোড থেকে কোটবাড়ি ভাড়া জনপ্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা। চট্টগ্রাম থেকে আসা দর্শনার্থীদের নামতে হবে পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড। সেখান থেকে অটোরিকশায় কোর্টবাড়ি। জনপ্রতি ভাড়া নিবে ৩০ থেকে ৪০ টাকা।
মন্তব্য করুন