মেঝেতে তোশকের বিছানা। একটি ফ্রিজ, একটি টেবিল, একটি ওয়ারড্রব। দেখে মনে হবে নিম্ন মধ্যবিত্ত কোনো পরিবারের শয়নকক্ষ। ১৩ শতাংশ জমিতে দুই তলা ভবনের তিন কক্ষবিশিষ্ট একটি ফ্ল্যাটের এক কক্ষে থাকেন আয়েশা আক্তার ও তার ১৫ বছরের কিশোরী কন্যা।
যৌথ বাড়িটিতে আয়েশার প্রয়াত স্বামীর জমির পরিমাণ চার শতাংশ। স্থানীয় জমির দর অনুযায়ী যার মূল্য কোটি টাকার ওপরে। দোকান আছে ৪টি। সম্পত্তি অনুযায়ী সচ্ছল জীবনযাপনের কথা থাকলেও মা-মেয়ের দিন কাটে অর্ধাহারে, অনাহারে।
ওই মায়ের দাবি, সাভারের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জমি, দোকান থাকলেও ওয়ারিশসূত্রে মালিক হয়েও এসব জমি কাজে আসছে না তার। সবই নিজের দখলে রেখে ভোগ করছেন তার দেবর। ঢাকার সাভারের গেন্ডার পূর্ব ভবানীপুর এলাকার বাসিন্দা তারা।
জানা যায়, ক্রয় সূত্রে সাভারের পূর্ব ভবানীপুর, সাভার নামা গেণ্ডা ও সাভার থানা রোড এলাকায় ৩টি জমির মালিক ছিলেন মুন্সী আলী আহমেদ। এর মধ্যে তার ১৩ শতাংশের দুই তলা বসতবাড়ির চার শতাংশ বড় ছেলে মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ শরীফকে, ছোট ছেলে খায়রুল আহমেদ আমিনকে চার শতাংশ ও স্ত্রী মোসলেমা খাতুনকে তিন শতাংশ জমি দলিল মূলে লিখে দেন।
জমির সব কাগজপত্র নিজের কব্জায় রাখেন খায়রুল। ২০১২ সালে কিডনিজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে স্ত্রী আয়েশা আক্তার ও এক কন্যা রেখে মারা যান মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ শরীফ। ২০১৯ সালে মারা যান মোসলেমা খাতুন।
স্বামীর অসুস্থতার সময় থেকেই জমি বিক্রি করে স্বামীর চিকিৎসার জন্য জমির নথি ও কাগজপত্র দেবরের কাছে চেয়ে আসছিলেন আয়েশা আক্তার। তবে এত বছরেও সেসব বুঝে পাননি তিনি। এর মধ্যে ২০২২ সালে জোরপূর্বক অল্প মূল্যে সব জমি নিজের নামে করে নিতে বায়না দলিল করিয়ে নেন খায়রুল। ফলে সাভারের মতো শিল্পাঞ্চলে বহু সহায়সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও কষ্টে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে মা-মেয়েকে।
সম্প্রতি ওই বাড়িটিতে গিয়ে দেখা যায়, ১৩ শতাংশ জমির চারপাশে সীমানা দেয়াল। মূল ফটকের পাশে ৩টি দোকান। ভেতরে ঢুকে বামে গাড়ির গ্যারেজ, মাঝে প্রায় ৩-৪ শতাংশ ফাঁকা জমিতে বেশ কিছু গাছপালা। উত্তর পাশে দুই তলা ভবন। নিচতলায় তিন কক্ষবিশিষ্ট একটি ফ্ল্যাট। এ ফ্ল্যাটের একটি কক্ষে কোনোমতে বসবাস করছেন ওই মা-মেয়ে। কক্ষটির দরজা সম্প্রতি সারাই করা হয়েছে। জানালার কাঁচও ভাঙা। ওয়েলক্লথ দিয়ে কোনোমতে ঢেকে সেটি আটকে রাখা হয়েছে। মেঝেতে পাতা বিছানায় বসে দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন দু’জনই।
আয়েশা আক্তার বলেন, ২০১২ সালে হঠাৎ অসুস্থ হন আমার স্বামী। ক্রমেই অসুস্থতা বাড়তে থাকে। অর্থকষ্ট ও চিকিৎসার জন্য জমি বিক্রি করতে চেয়েছিল। ওই সময় সে জমির কাগজপত্র চেয়েছিল তার ভাইয়ের কাছে। কিন্তু সে দেয়নি। তিন লাখ টাকায় একজন কিডনিদাতাও পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু টাকা সংকুলান করা যায়নি। তাই কিডনিও দিতে পারিনি। প্রায় এক বছর রোগে ভুগে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর দুর্দশা বেড়ে যায়। বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন মা ও মেয়ে।
বাড়ি থেকে তাড়াতে দেবর নানাভাবে চেষ্টা করছে জানিয়ে তিনি বলেন, স্বামী বেঁচে থাকতে কোনো দিন দোকানেও যাইনি। কিন্তু এক সময় তারা আমাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বললো। এরপর তারা আমাকে নানাভাবে হুমকিধমকি দিয়ে আসছিল। শারীরিক নির্যাতন ছাড়াও অপবাদ দিয়ে মানহানিও করে। একপর্যায়ে ২০২২ সালের দিকে অস্ত্রের হুমকিসহ স্থানীয় প্রভাবশালীদের দিয়ে হুমকি দিয়ে জমি লিখে দিতে বলে। এরপর নিজেরাই একটি বায়না দলিল বানায়। আমিও ভাবলাম, এত জটিলতা বাদ দিয়ে জমি বিক্রি করি। এরপর স্থানীয় প্রভাবশালীদের নিয়ে বসে সেই জমির বায়না দলিল করা হয়। মোট ২৪ লাখ টাকার। এর মধ্যে ১০ লাখ টাকা নগদ দিবে বলে জানায়। কিছু টাকা দিলেও পরে তা আবার ফেরত নিয়ে নেয়। দলিলে লেখা ছিল তিন মাসের মধ্যে সব টাকা পরিশোধ করবে। কিন্তু কোনো টাকাই দেয়নি।
তিনি বলেন, জমির নামে কোনো টাকা দেয়নি। দোকান ভাড়া, বাসা ভাড়াসহ লাখ টাকা আয় আসে সম্পত্তি থেকে। কিন্তু আমরা পাই মাসে পাঁচ হাজার টাকা। বাসার দুইটি গেটের একটিরও কোনো চাবি দেয় না। পানির মোটরের নিয়ন্ত্রণও তাদের কাছে। প্রয়োজনের সময় পানি পাওয়া যায় না। শ্বশুরের কেনা প্রায় ২০ লাখ টাকার গাড়ি বিক্রি করে নিজে নতুন গাড়ি কিনে সেটি নিজে ব্যবহার করছেন। সেটিরও কোনো অংশ পাইনি।
ক্লাস এইটে পড়ুয়া ১৫ বছর বয়সী কন্যাকে নিয়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আগে তিন কক্ষের ফ্ল্যাটে আমরা থাকতাম। তবে কয়েক বছর আগে ছোট বোনকে এনে দুই কক্ষ দিয়ে দেয়। সে তার পরিবারসহ এখানে থাকে। আমাদের দেওয়া হয়েছে একটি কক্ষ। অথচ ওই বোনের এখানে জমি নেই। আমার স্বামীর জমি থাকলেও আমাদের থাকার জায়গা নেই। সে যদি বেঁচে থাকত, স্বামী যদি বেঁচে থাকত, বিছানায়ও পড়ে থাকত। আমার সঙ্গে এ রকম অন্যায় করতে পারত না।
মৃত মোসলেমের কিশোরী কন্যা বলেন, আজ বাবা নেই বলে কোনো বিচার পাচ্ছি না। তিন বেলা ঠিকমতো খেতেও পাই না। ভয়ে ও আতঙ্কে থাকতে হয়। গায়ে হাত তুলতে আসে তারা। বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা কোথায় যাব, কার কাছে থাকব। বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে সে।
বিষয়টি নিয়ে থানা পুলিশের কাছে একাধিক অভিযোগ, সাহায্য চেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি আয়েশা আক্তার। গত ২৭ এপ্রিল সকালে মেয়ের জন্য নাশতা বানাতে রান্না ঘরে ঢুকলে তাকে বাধা দেন ফ্ল্যাটের দুই কক্ষের বাসিন্দা তার ননদ। এক পর্যায়ে মা-মেয়েকে ধরে মারধর করেন। তাদের চুল ধরে টানাটানিসহ মারধরের ভিডিও এ প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে। এ ছাড়াও একাধিক অভিযোগের কপি পাওয়া যায়। তবে ওয়ারিশ সূত্রে পাওয়া সম্পত্তির কোনো ভাগ যেমন পাননি, তেমনই ভাগ্যের পরিহাসে পাননি বিচারও।
বিষয়টি নিয়ে তার দেবর খায়রুল আহমেদ আমিনের সঙ্গে কথা হয়। সব সম্পত্তি নিজেদের দখলে আছে বলে জানান তিনি। তার ভাষ্য, ভাতিজি ও ভাবি ফ্ল্যাটে থেকে দেহব্যবসাসহ নানা অপকর্মে জড়িত। তিনি জানান, ভাবি-ভাতিজি বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে জমি বিক্রির জন্য বায়নার টাকা নিয়েছেন। দলিল হলে তারা চলে যাবেন। জমির দখল, বাড়িতে যথাযথ ওয়ারিশ দেওয়া, দোকান ভাড়াসহ সম্পত্তির অংশ বুঝিয়ে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় কয়েকজনের নাম বলে তাদের কাছে খোঁজ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। মাসে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া, গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল নিজেই পরিশোধ করেন বলেও জানান তিনি। তবে সম্পত্তি থেকে আরও বেশি টাকা আয় হয় এমন বিষয় উল্লেখ করলে কোনো জবাব দেননি তিনি।
এ বিষয়ে সাভার মডেল থানার ওসি মোহাম্মদ শাহজামান বলেন, অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সত্যতা পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া জমিজমাসংক্রান্ত বিষয়ে আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
সাভার উপজেলা ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (ভূমি) এসএম রাসেল ইসলাম নূর আদালতে দখল উচ্ছেদ মামলার পরামর্শ দেন। এ ছাড়া উপজেলা প্রশাসন থেকে যে কোনো ধরনের আইনগত সহায়তা দেওয়ারও আশ্বাস দেন।
মন্তব্য করুন