সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. এনায়েত উল্যা পাটওয়ারী বলেছেন, ‘মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত এমন জাতি ছাড়া দাবি আদায় করা সম্ভব না। যেখানেই রক্ত পড়েছে, সে জাতিই জেগে উঠেছে, সেখানেই বিপ্লব হয়েছে, পরিবর্তন হয়েছে। কাজেই রক্তের ঋণ ও এর মূল্য অনেক বেশি।’
সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তা কেন্দ্রের আয়োজনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির (চবিসাস) কার্যালয়ে ‘অন্তর্বর্তী সরকার ও জনপ্রত্যাশা’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
লিখিত বক্তব্যে অধ্যাপক ড. মো. এনায়েত উল্যা পাটওয়ারী বলেন, ‘প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন লক্ষ করা যাচ্ছে। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের এমন তৎপরতা আমাদের ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতার’ লক্ষ্য বাস্তবায়নে বিরাট বাধা সৃষ্টি করবে। মানুষ আবারও হতাশায় নিমজ্জিত হবে। পরিণামে পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসররা ষড়যন্ত্রে মেতে উঠবে এবং তা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করবে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তাদের বক্তব্য, কার্যক্রম সুবিবেচিত হতে হবে। জনগণ যদি বর্তমান ধারার রাজনীতির বিকল্প খুঁজে না পায় তাহলে জাতির জন্য তা চরম ভোগান্তির কারণ হবে। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সুবিধাবাদী গোষ্ঠী ষড়যন্ত্র করে আমাদের ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতার’ আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধূলিস্যাৎ করে দেবে। যদি তা হয় তবে তা হবে আমাদের জাতির জন্য চরম দুর্গতি, যা থেকে আবার মুক্তি পাওয়া দুরূহ হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বিভাজন চাই না, ঐক্য চাই। একক কোনো দল বা গোষ্ঠীর পক্ষে বর্তমান বাংলাদেশের কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এজন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারলে বাংলাদেশের সামনে রয়েছে সুন্দর ভবিষ্যৎ। আমাদের বিশ্বাস একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আমাদের ছাত্রসমাজ অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করে যাবে। এক্ষেত্রে নাগরিক সমাজসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সহযোগিতার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে ছাত্র-জনতার প্রত্যাশার আলোকে নিজেদের পুনর্গঠন করে, বিন্যস্ত করে দেশ পরিচালনার জন্য উপযোগী হিসেবে গড়ে উঠতে হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা জনপ্রত্যাশার ছয়টি বিষয় তুলে ধরেন। সেগুলো হলো :
প্রথমত, গণঅভ্যুত্থানে নৃশংসতার শিকার গুলিবিদ্ধ (চোখে, মুখে, পায়ে) মানুষদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। জীবনঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানো উচিত। শহীদ, আহত এবং নির্যাতিত ব্যক্তিদের পরিবারের সর্বাগ্রে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
দ্বিতীয়ত, গত ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের বাকি কর্মকর্তাদের শিগগিরিই বরখাস্ত করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা জরুরি। তাদের দুর্নীতি তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
তৃতীয়ত, শিগগিরই পুলিশ বাহিনীকে পুনর্গঠন করে এ বাহিনীকে জনবান্ধব করার কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া দরকার। পুলিশের হারানো গৌরব বিশেষ করে তাদের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস নিরসনের ব্যবস্থা করা। দুর্নীতিবাজ সব পুলিশ কর্মকর্তা এবং সিপাহিদের আইনের আওতায় নিয়ে এসে তদন্তপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া অত্যাবশ্যক। শিগগিরিই পুলিশ বাহিনীতে সিপাহি ও কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়ে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা সময়ের দাবি।
চতুর্থত, পতিত স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের আমলে প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে টেন্ডারবাজি, নিয়োগবাণিজ্যসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের বিরুদ্ধে ইউজিসি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছিল, কিন্তু সঠিকভাবে তদন্ত হয়নি এবং কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত হলেও তদন্ত রিপোর্ট অনুসারে কোনো শাস্তি কার্যকর হয়নি। তাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের দুর্নীতি তদন্ত করে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের জন্য ‘উচ্চশিক্ষা দুর্নীতি দমন কমিশন’ গঠন করা হোক।
পঞ্চমত, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসার কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হোক। ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট চিরতরে মূলোৎপাটনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।
সর্বশেষ, একটি সু-সমন্বিত ও যুগোপযোগী জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য অতি শিগগিরিই ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন’ গঠন করে দায়িত্ব প্রদানপূর্বক সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়ার দাবি জানান তারা।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শহীদুল হক, দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মোর্শেদুল হক। সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। বক্তারা নতুন বাংলাদেশ নিয়ে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
মন্তব্য করুন