দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপউপাচার্য, কোষাধ্যক্ষসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা শিক্ষকবৃন্দ পদত্যাগের পর বিশ্ববিদ্যালয়টির স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
প্রশাসনিক ও আর্থিক দায়িত্ব পালনের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জ্যৈষ্ঠ শিক্ষককে দায়িত্ব দেওয়া হলেও, গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার না থাকায় স্বাভাবিক কার্যক্রম কার্যত বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।
ইতোমধ্যে দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ হয়েছে। যেখানে শিক্ষকের গবেষণা দক্ষতা, একাডেমিক দক্ষতা, বিশ্বের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জিত পিএইচডি ডিগ্রি ও প্রশাসনিক দক্ষতা মাপকাঠি হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অন্যতম প্রধান এই বিদ্যাপীঠে এখনো ভিসি নিয়োগ হয়নি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কে হবেন তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে চলছে আলোচনা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, উপাচার্য নিয়োগের আলোচনায় আছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক।
ড. মো. হায়দার আলী বিশ্বাস
আলোচনায় আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মো. হায়দার আলী বিশ্বাস। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জার্নালে ২৫০টির অধিক গবেষণা প্রবন্ধ ও ৬টি বই প্রকাশিত হয় তার। মেধাবী এই শিক্ষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক ও ফলিত গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি রেকর্ড মার্কসহ উভয় পরীক্ষায় ১ম শ্রেণিতে ১ম স্থান অর্জন করেন এবং প্রাইম মিনিস্টার গোল্ড মেডেলসহ বিভিন্ন পুরস্কার অর্জন করেন।
তিনি ইউরোপের বিখ্যাত ইউনিভার্সিটি অব পোর্তো, পর্তুগাল থেকে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। দেশে ও বিদেশে ১০ জন শিক্ষার্থী তার অধীনে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ড. বিশ্বাস বাংলাদেশ ম্যাথমেটিকাল সোসাইটির নির্বাচিত সভাপতির ছিলেন ও বর্তমানে বাংলাদেশ সোসাইটি অর ম্যাথমেটিকাল বায়োলজি-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থী মীর মুগ্ধর শিক্ষক ড. বিশ্বাস আন্দোলনের শুরু থেকে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছিলেন ও আহত শিক্ষার্থীদেও চিকিৎসায় সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন।
ড. মো. হারুনর রশিদ খান
আলোচনার আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. হারুনর রশিদ খান। তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জার্নালে ১৩০টির অধিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন যেগুলোর সাইটেশন সংখ্যা ১১ হাজারের ওপরে। দীর্ঘ ৩২ বছরের শিক্ষকতা ও গবেষণা জীবনে ড. খান নোবলেজয়ী গবেষকদের সঙ্গেও কাজ করেন। ২০১২ সালের ২৬ মে ‘দৈনিক আমার দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশ নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে তার লেখা ‘সাদা ওয়াইন ও টেকসই গণতন্ত্র’ কলামটি সে সময় ড. ইউনূসের শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে ব্যাপক ইতিবাচক সাড়া ফেলে।
কর্মজীবনের শুরুতে তিনি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। পরে জাপান সরকারের মনবুশো বৃত্তিতে সাগা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি এবং টোকিও ইনিস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে প্রথম ও সাগা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় পোস্ট ডক্টরাল সম্পন্ন করেন। তিনি সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য, শিক্ষক সমিতির সেক্রেটারি, হলের প্রভোস্ট, ডিন, পদার্থবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান ও রিসার্চ সেলের ডিরেক্টরসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন।
ড. খান সৌদি আরবের কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৬ সাল থেকে অধ্যাপক হিসেবে লিয়েনে পাঁচ বছর কর্মরত ছিলেন। কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ এটোমিক এনার্জি কমিশন ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের মধ্যে চলমান যৌথ গবেষণা দলের নেতৃত্বও দিচ্ছেন তিনি। গবেষক হিসেবে তিনি জাপানের হাই এনার্জি এক্সেলেটর রিসার্চ অর্গানাইজেশনে (কেইকে) বেল কোলাবরেটর এবং ইতালির আবদুস সালাম ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স (আইসটিপি)-এর রেগুলার অ্যাসোসিয়েট ছিলেন।
ড. রেজাউল করিম
নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. রেজাউল করিমের নামও উপাচার্য হিসেবে আলোচনায় এসেছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বিভিন্ন সময়ে নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা ডিসিপ্লিনের প্রধান, ডিন, শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং ইনিস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স সেলের পরিচালকসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি হায়ার এডুকেশন কোয়ালিটি এনহান্সমেন্ট প্রজেক্ট (হেকেপ)-এর অধীনে একটি গবেষণা প্রকল্প সম্পন্ন করেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্বব্যাংক পরিচালিত কলেজ এডুকেশন ডেভলপমেন্ট প্রজেক্টে (সিইডিপি) কনসালটেন্ট হিসেবে যুক্ত ছিলেন। গবেষণার পাশাপাশি আরও কিছু প্রতিষ্ঠানে তিনি কনসালটেন্সি সেবা দিয়েছেন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, উপাচার্য হিসেবে তারা একজন যোগ্য ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিকেই প্রত্যাশা করছেন। যিনি দলীয় লেজুড়বৃত্তিকে প্রশ্রয় দেবেন না, শিক্ষকদের মর্যাদা সমুন্নত রাখবেন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিধি অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করবেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্যান্য অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহউপাচার্য, কোষাধ্যক্ষসহ প্রশাসনিক পদে দায়িত্বরতরা একের পর এক পদত্যাগ করতে থাকেন। তবে এ ঘটনায় ব্যতিক্রম ছিল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্ররাজনীতিমুক্ত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. মাহমুদ হোসেন পদত্যাগ করতে চাইলেও, সাধারণ শিক্ষার্থীরা তার পদত্যাগ ঠেকাতে মিছিল করে। এমন ব্যতিক্রম দৃশ্য অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায়নি।
শিক্ষাবিদরা মনে করেন, একাডেমিক, গবেষণা ও প্রশাসনিক দক্ষতা এবং ব্যক্তিত্ব উপাচার্যকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরিতে মূখ্য ভূমিকা রাখে। তাই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক দক্ষতা, গবেষণা দক্ষতা ও প্রশাসনিক দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষকদের উপাচার্য, উপউপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগের পক্ষে মত দেন শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
মন্তব্য করুন
আর্কাইভ 
| ২২ আগস্ট ২০২৫ 
