ঢাবি প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:২৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

ডাকসুর সভায় গুম-খুন বন্ধে জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ ও জাতীয় ঐক্যের দাবি

গুম-খুন বন্ধ, জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ ও জাতীয় ঐক্যের দাবি
ছবি : সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) আয়োজিত সভায় বক্তারা গুম-খুনের অবসান, জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, মানবাধিকার সুরক্ষা, নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং জাতীয় ঐক্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

বুধবার (১০ ডিসেম্বর) আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার অডিটোরিয়ামে ডাকসুর উদ্যোগে এক আলোচনা সভায় এসব বিষয় উঠে আসে।

ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক এস এম ফরহাদ বলেন, ১৯৪৮ সালে মানবাধিকার দিবস পালনের সিদ্ধান্তের পরও বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ-সংঘাত থামেনি। কোরিয়া, ভিয়েতনাম, মধ্যপ্রাচ্যসহ বহু অঞ্চলে যুদ্ধ চলমান। গাজা পরিস্থিতি তার সাম্প্রতিক উদাহরণ।

তিনি বলেন, মানবাধিকার দিবস এলেই সেমিনার-সভা হয়, কিন্তু সবচেয়ে জরুরি বিষয়- মানুষের জীবন রক্ষা, সেটি নিশ্চিত করা যায় না। বাংলাদেশেও বহু মানুষ আজও নিখোঁজ। আনন্দকে পাওয়া গেলেও অলিউল্লাহ, মুকাদ্দাস বা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সন্ধান মেলেনি।

ফরহাদ বলেন, ’৭১-এর পর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন ছিল, তা পূরণ হয়নি। গত ১৫ বছর ছিল মানবাধিকার সংকটের ভয়াবহ সময়। ২০২৪ পরবর্তী সময়েও তা পুরোপুরি বদলায়নি।

তিনি বলেন, শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়— ব্যক্তি পর্যায় থেকে অন্যের অধিকার রক্ষার অঙ্গীকার গ্রহণ করতে হবে। একজন মানুষকে হত্যা করা মানে পুরো মানবজাতিকে হত্যা করা— এই নীতি অনুসরণ করলেই মানবাধিকার সুরক্ষা অর্থবহ হবে।

জাতীয় গুম কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন বলেন, ডাকসুর মাধ্যমে প্রথমবার অফিসিয়ালি মানবাধিকার দিবস পালন করা হচ্ছে, যা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তিনি ছাত্রদের স্মরণ করিয়ে দেন- পূর্বে ছাত্র সংগঠনগুলোর নির্যাতনের ফলে ছাত্রদের মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে, এসব ঘটনা পরিবর্তন করাই ডাকসুর দায়িত্ব।

তিনি উল্লেখ করেন, অতীতে মোকাদ্দেস–মোকাদ্দেমসহ বহু মানুষ র‌্যাবের হাতে তুলে নেওয়ার পর নিখোঁজ হয়েছেন। বহু পরিবার ভয়ে পথ চলতে পারেনি; অনেকে চোখের সামনে প্রিয়জনকে হারিয়েছেন।

তিনি বলেন, গুমের ঘটনা ভুলে গেলে চলবে না— কমিশন প্রতিটি ঘটনার সত্য উদঘাটনে কাজ করছে।

লিটন রাজনৈতিক বিভাজন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো সহনশীলতা এবং বিরোধী মতের প্রতি সম্মান।

বেগম রোকেয়া পদকপ্রাপ্ত ড. নাবিলা ইদ্রীস গুম-ভুক্তভোগীদের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।

নাবিলা বলেন, শিক্ষার ক্ষমতা হরণের উদ্দেশ্যে অনেককে ইলেকট্রিক শক পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে— ফলে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তিনি ছাত্রদের সতর্ক করে বলেন, শিক্ষা ও ক্যারিয়ার কোনোদিনই দ্বিতীয় অগ্রাধিকার হতে পারে না— গুম-ভুক্তভোগীদের পুনর্বাসন সংগ্রাম থেকে তা স্পষ্ট। ছাত্ররাজনীতি সংশ্লিষ্ট টর্চার ও গেস্টরুম সংস্কৃতির বন্ধসহ প্রতিটি ঘটনা নথিবদ্ধ করার পরামর্শ দেন।

নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, পরিবর্তনের পথে নারীদের উপস্থিতি অপরিহার্য।

গুমের শিকার ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বিন কাশিম (আরমান) বলেন, শত শত পরিবার এখনো জানে না তাদের প্রিয়জন জীবিত না মৃত। রাষ্ট্র তাদের জবাব দিতে ব্যর্থ হয়েছে। গুম একটি জাতীয় ক্ষত, যা থেকে মুক্তি পেতে প্রথম শর্ত হলো কঠোর জবাবদিহিতা।

তিনি গুম-ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর পুনর্বাসনকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প করা সম্ভব হলেও গুম-পূর্ববর্তী পরিবারগুলোর আর্থিক নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্র কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

তিনি শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তার দেশত্যাগের ঘটনায় তদন্ত না হওয়াকে ‘রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা’ উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টার প্রতি তদন্ত কমিশন গঠনের আহ্বান জানান।

জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারের দপ্তর মিশনপ্রধান (ভারপ্রাপ্ত) হুমা খান বলেন, মানবাধিকার কোনো কঠিন বা জটিল বিষয় নয়। এটি খুব সহজভাবে বলা যায়— মানুষ হিসেবে সবাই সমান অধিকার পাবে। তাদের ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ, রঙ বা শ্রেণি যাই হোক না কেন। অনেকেই এটিকে পাশ্চাত্যের ধারণা মনে করেন, কিন্তু আমি তা চ্যালেঞ্জ করি। মানবাধিকার সনদ রচনায় বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছিলেন।

তারও আগে, আমাদের নিজস্ব ধর্মীয় গ্রন্থ এবং বিভিন্ন সংস্কৃতিতেই মানবাধিকারের মূলনীতি সমতা, ন্যায়বিচার, সহানুভূতি ও সম্মান স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। সুতরাং মানবাধিকার আমাদের জন্য কোনো বিদেশি ধারণা নয়; এটি আমাদের নিজেদের মূল্যবোধেরই বিস্তার, বলেন তিনি।

হুমা খান বলেন, কিন্তু বাস্তবতা হলো— রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান জনগণের সেবায় নিয়োজিত হওয়ার কথা, কারণ জনগণের ট্যাক্সের অর্থেই তাদের বেতন চলে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও জনগণের সেবক— শাসক নন। আমাদের মনে এই মানসিক পরিবর্তন আনতে হবে। তরুণ প্রজন্মই এ পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিতে পারে।

তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি, নির্বাচনের পর যে সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হবে, তাতে এই সাংস্কৃতিক পরিবর্তনও আসবে— যেখানে সরকার ক্ষমতার উৎস নয়; বরং জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করবে। আজ আমরা যে পরিবর্তনের কথা বলছি, গত বছর বাংলাদেশের জনগণ তার ভিত্তি স্থাপন করেছে। বিশ্বজুড়ে অনেক দেশ চেষ্টা করে— কিন্তু সফল হয় খুব কম।

ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েম বলেন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর আন্দোলন এবং সাম্প্রতিক আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। গত ১৬ বছরে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদী শাসনের অধীনে ছিল এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ছাত্রলীগের মাধ্যমে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পরিণত করা হয়েছিল।

তিনি বলেন, ইসলাম চর্চা বা নামাজ পড়ার অভিযোগে বহু শিক্ষার্থীকে শিবির সন্দেহে নির্যাতন করা হয়েছে, যা উদযাপন পর্যন্ত করা হয়েছে। যারা মানবাধিকার কর্মীর নামে গুম–খুন এবং দমননীতিকে বৈধতা দিয়েছিলেন, তারা জাতির শত্রু। তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

সাদিক কায়েম বলেন, নতুন বাংলাদেশেও কিছু দল পুরোনো দমননীতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। নতুন বাংলাদেশ হবে সব মানুষের অধিকার ও ইনসাফের দেশ, যেখানে গুম-টর্চার থাকবে না।

ডাকসুর এই আয়োজনকে বক্তারা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হিসেবে মূল্যায়ন করেন এবং গুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

যেভাবে গভীর গর্তে পড়েছিল শিশুটি, জানালেন মা

২৬ টন পলিথিন জব্দ, ৩ জনের কারাদণ্ড

পুরোনো ফোন আমদানি নিয়ে সিদ্ধান্ত দিল সরকার

লোকসান পুষিয়ে নিতে আগাম আলু চাষে ব্যস্ত কৃষকরা

নির্বাচন নিয়ে ন্যূনতম সংশয় সৃষ্টির কোনো অবকাশ নেই : উপদেষ্টা সাখাওয়াত

আবার পিছিয়ে গেল ব্রাকসু নির্বাচন

রাশেদ খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব দলের আরেক নেতার

জামায়াত কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা

এন‌ইআইআর চালু হচ্ছে ১৬ ডিসেম্বর, ফোন নিবন্ধন চলবে মার্চ পর্যন্ত

ডাকসুর সভায় গুম-খুন বন্ধে জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ ও জাতীয় ঐক্যের দাবি

১০

২০২৬ বিশ্বকাপ পর্যন্ত নেইমারকে ধরে রাখতে আত্মবিশ্বাসী সান্তোস

১১

আবারও হাফেজ আনাসের বিশ্বজয়

১২

ধানের শীষ বিজয়ী হলে দেশ রক্ষা পাবে : তারেক রহমান

১৩

সাতক্ষীরায় ৮ বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ

১৪

পাশাপাশি ২ ভবন ধসে নিহত ১৯

১৫

১৪০ আসনে প্রার্থী দিল এনপিপি

১৬

৬ ঘণ্টার বেশি অবরুদ্ধ থেকে সচিবালয় ছাড়লেন অর্থ উপদেষ্টা

১৭

খালেদা জিয়া চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছেন : ডা. জাহিদ

১৮

বরগুনায় টেকসই প্লাস্টিক ব্যবহার ও সামুদ্রিক আবর্জনা প্রতিরোধে সেমিনার

১৯

শীতে ত্বকের যত্নে পেট্রোলিয়াম জেলি নাকি গ্লিসারিন, কোনটি সেরা?

২০
X