দলীয় ক্ষমতার অপব্যবহার, সরকারি কাজে বাধাদান, শিক্ষা কর্মকর্তাকে তুলে নেওয়ার হুমকি, গোপনে সরকারি বই বিক্রিসহ নানা অপকর্মের জন্ম দিয়ে আলোচনার শীর্ষে কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার এক আওয়ামী নেতা।
রৌমারী উপজেলার সরকারি সিজি জামান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবু হোরায়রা ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত। তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে আছেন। নিয়মিত অংশ নেন দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতেও।
আরও পড়ুন : চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে সচিবের নির্বাচনী প্রচার
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এর রাজনীতি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ অংশে বলা আছে, সরকারি কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের বা রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গ সংগঠনের সদস্য হতে অথবা অন্য কোনোভাবে যুক্ত হতে পারবেন না অথবা বাংলাদেশ বা বিদেশে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে বা কোনো ধরনের সহায়তা করতে পারবেন না।
রৌমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০২২ সালের ২৯ নভেম্বর রৌমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে হট্টগোল, কেন্দ্রীয় নেতাদের অবরুদ্ধ, হুমকিসহ নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের সুপারিশে রৌমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিতে আবু হোরায়রা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মী বলেন, প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের ছত্রছায়ায় আবু হোরায়রা দলীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে লাঞ্ছিত এবং বিনামূল্যে দেওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারি বই বিক্রি এবং সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ও নীতিমালা উপেক্ষা করে স্থানীয় নেতাকর্মীদের কথায় কথায় বহিষ্কার করে থাকেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারি সিজি জামান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু হোরায়রার বিরুদ্ধে ২০১২ সালে বিনামূল্যের বই বেআইনিভাবে বিক্রির অভিযোগ ওঠে। সে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা মাধ্যমিক কার্যালয়ের অফিস সহকারী বাদী হয়ে কুড়িগ্রাম স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-৩ এ ২০১২ সালের ১৯ মে একটি মামলা করেন। এ ছাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক রোকন উদ্দিনকে চারিত্রিক স্খলনজনিত অভিযোগ তুলে কেন্দ্র কিংবা জেলা নেতাদের মতামত না নিয়েও দল থেকে বহিষ্কার করেন, যা গঠনতন্ত্র পরিপন্থি।
তৎকালীন উপজেলা একাডেমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (বর্তমানে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা) মো. মুকতার হোসেনকে সরকারি কাজে বাধা দেন। আবু হোরায়রার মনোনীত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোনোরকম প্রতিবেদন দাখিল না করার হুমকি দেন এবং অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। পরবর্তীতে প্রাণনাশের আশঙ্কায় জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ওই শিক্ষা কর্মকর্তা গত ২০২৩ সালের ২১ জানুয়ারি রৌমারী থানার ওসি বরাবর সাধারণ ডায়েরি করেন।
আবু হোরায়রা বিদ্যালয়ে নিয়মিত আসেন কিনা- জানতে চাইলে বিদ্যালয়ের শিক্ষক, অভিভাবক ও প্রতিবেশীরা এড়িয়ে যান। তাদের শঙ্কা, আবু হোরায়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় তারা হয়রানির শিকার হতে পারেন।
আরও পড়ুন : সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তারে লাগবে পূর্বানুমতি
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, বিদ্যালয় চলাকালেও আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে তার (আবু হোরায়রা) উপস্থিতি নজরে পড়ে। এমন কোনো কর্মসূচি নেই যেখানে আবু হোরায়রা উপস্থিত থাকেন না।
জেলা শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ২১ মে রৌমারী সিজি জামান উচ্চ বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ হয় এবং প্রধান শিক্ষক হিসেবে আবু হোরায়রার চাকরি ১৮ ডিসেম্বর ২০২২ সালে জাতীয়করণের মধ্য দিয়ে ২০২৩ সালের জুন থেকে সরকারি চাকরির হিসেবে সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন তিনি।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মুকতার হোসেন রৌমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হোরায়রা কর্তৃক সরকারি কাজে বাধা প্রদান ও হুমকি-ধমকির পরিপ্রেক্ষিতে থানায় জীবনের নিরাপত্তা আবেদনের বিষয়টি স্বীকার করেন।
একইসঙ্গে সরকারি চাকরি এবং দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন নীতিমালা পরিপন্থি কিনা- এমন প্রশ্নে রৌমারী সরকারি সিজি জামান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও রৌমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আবু হোরায়রা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে কোথাও বলা নাই যে, সরকারি চাকরি করলে দলীয় পদে থাকা যাবে না। এটা নিয়ে সাংবাদিকদের এত মাথাব্যথা কেন। এটা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। কেন এ বিষয়ে নিউজ করতে হবে আপনাদের।’ এমন নানা প্রশ্ন উল্টা তিনি এ প্রতিবেদককে ছুঁড়ে দেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মোস্তাফিজুর রহমান সাজু বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় কন্ডিশন দেওয়া হয়েছে, চাকরির জাতীয়করণ হলে দলীয় পদ ছাড়তে হবে। অথবা দলীয় পদে থাকলে চাকরি ছাড়তে হবে। আবু হোরায়রা সরকারি চাকরি থেকে ডিজি অফিসে পদত্যাগপত্র দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমান উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু জনান, রৌমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আবু হোরায়রা সংশ্লিষ্ট ডিজি অফিস এবং জেলা নেতাদের কাছেও পদত্যাগপত্রের কপি জমা দিয়েছেন। এখন দলীয় দায়িত্ব পালনে বাধা নাই।
এ বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শামছুল আলম জানান, রৌমারী সরকারি সিজি জামান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবু হোরায়রা অদ্য ২৫ জুলাই পর্যন্ত পদত্যাগপত্রের কপি জেলা শিক্ষা অফিস, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, রৌমারী ইউএনও অফিস কিংবা ট্রেজারিতে জমা দেন নাই। একইসঙ্গে সরকারি চাকরি ও দলীয় দায়িত্ব পালনের বিষয়টি প্রমাণ হলে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন