ড্রাইভার নিয়োগে শর্তের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নিজের এক আত্মীয়কে ড্রাইভার পদে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈনের বিরুদ্ধে।
নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি ভাইবা বোর্ডের পূর্বেই উপাচার্যের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে প্রভাব বিস্তার করেন ক্যাম্পাসে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য এক ড্রাইভারের থেকে চাবি নিয়ে চালান বাস।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আত্মীয় পরিচয় দেওয়া ব্যক্তির শিক্ষাগত যোগ্যতা ও বয়স বেশি হওয়া সত্ত্বেও ড্রাইভার হিসেবে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। অপরদিকে বাসের চাবি হস্তান্তর করার অপরাধে অদক্ষতা ও অসদাচরণের অভিযোগ এনে শাহিনুর রহমান নামে এক ড্রাইভারকে শাস্তি দিয়েছেন উপাচার্য।
এদিকে উপাচার্যের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে ড্রাইভার কচি শেখের কয়েকটি অডিও রেকর্ড প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। যেখানে কচি শেখ নিজেকে উপাচার্যের আত্মীয় বলে পরিচয় দেন এবং তাকে উপাচার্যের পক্ষ থেকে নিয়োগ দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে বলে জানান।
অডিও রেকর্ডে কচি শেখ শাহীনুরকে বলেন, আপনি কারও কাছে কইয়েন না, আমি হলাম স্যারের (উপাচার্য) আত্মীয়। না হলে বোঝেন নাই, আমার চাকরি এক চান্সে হয়ে গেছে? স্যারের (উপাচার্য) সঙ্গে আমি তার আপন ভাগনেকে দিয়ে দুবার কথা বলিয়েছি। যিনি আমাকে চাকরি দিয়েছেন তিনি স্যারের আপন ভাগনে। আমাকে স্যার চেনেন ইন্টারভিউয়ের আগে থেকেই। স্যারের ভাইয়ের ছেলেও আমার আপন ভায়রা। তাদের মাধ্যমেই আমি এখানে এসেছি। আমাকে নিয়োগ দেওয়ার আগেই চাকরি হওয়ার বিষয়ে নিশ্চয়তা দিয়েছে। না হলে কি এখানে আসতাম? আমি এখানে ঢুকলেই আপনি এবং মনির ভাই আমার আপন ভাই হবেন। আমি যাকে বুক দেই তার কখনও ক্ষতি করি না।
তবে রেকর্ডের বিষয়ে কচি শেখকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান, এটা অনেক আগের কথা। তখন কী বলেছিলাম মনে নেই। আমি গরিব মানুষ, তখন হয়ত ভুলে বলে ফেলেছিলাম। কিন্তু ভিসি স্যার আমার আত্মীয় নয়। ভিসি স্যার ও আমার বাড়ি এক জায়গায়, এতটুকুই শুধু।
শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং বয়সের বিষয়ে তিনি জানান, মিথ্যা কথা বলে লাভ নাই, আমি ম্যাট্রিক পাস করিনি। তবে কাগজপত্র দেখে বয়স জানাতে হবে।
এদিকে নিয়োগের আগে গাড়ি চালাতে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে শাহিনুর রহমান জানান, আমাকে ড্রাইভার মনির ভাই বলেন, কচি শেখ ভিসি স্যারের আত্মীয়। তার নিয়োগ হয়ে যাবে। তাকে যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসের নিয়মগুলো দেখিয়ে দেই। ভিসি স্যারের কথা বলাতে আমি পরীক্ষার আগের দিন তাকে গাড়ি চালানোর সুযোগ দিতে বাধ্য হই। পরে আমাকে শোকজ করা হলে তখনও কচি শেখ নিজেকে উপাচার্যের ভাইয়ের ছেলের ভায়রা বলে পরিচয় দেন।
তবে উপাচার্যের আত্মীয়কে গাড়ি চালাতে দেওয়ার পরেও কেন তিনি শাস্তি পেয়েছেন জানতে চাইলে মো. শাহিনুর জানান, আমি দীর্ঘদিন সাবেক রেজিস্ট্রার আবু তাহের স্যারের গাড়ি চালিয়েছি। এজন্য বিভিন্ন সময় উপাচার্য আমাকে কটূক্তি করে কথা বলতেন। এ ছাড়াও আমার নামে যে বিভাগীয় মামলা চলমান ছিল, সেখানে শোকজের জবাবে আমি কচি শেখকে উপাচার্যের আত্মীয় বলে উল্লেখ্য করায় আমাকে এ শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে। যদিও আমি উল্লেখ করেছিলাম, উপাচার্যের ‘আত্মীয়’ এটি আমার বক্তব্য নয়। বরং কচি শেখ আমাকে এ পরিচয় দিয়েছেন।
বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেতারা। তারা দাবি করেন, উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেই শিক্ষক-কর্মকর্তা থেকে সর্বস্তরের নিয়োগে স্বজনপ্রীতি এবং পছন্দের প্রার্থীকে টেন্ডার বাগিয়ে দেওয়ার মতো অপকর্মে লিপ্ত হয়েছেন। কচি শেখের নিয়োগ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান বলেন, নিয়োগের পূর্বেই কচি শেখ ভিসির আত্মীয় বলে স্বীকার করেছেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নিয়োগও পেয়েছেন তিনি। অথচ শাস্তি পেলেন একজন সাধারণ ড্রাইভার। মূলত এখানে সম্পূর্ণ ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত।
উপাচার্য নিজের আত্মীয়কে নিয়োগ দিয়েছেন পাশাপাশি শোকজের জবাবে ড্রাইভার শাহিনুর মূল ঘটনা ফাঁস করায় ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে তাকে শাস্তি দিয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে ভিসি এবং তার পরিবার আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে সংঘবদ্ধভাবে জড়িত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিয়োগপ্রাপ্ত কচি শেখের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া উপজেলার গিমাডাঙ্গা গ্রামে। ২০২২ সালের ১৪ ডিসেম্বর দুজন হেভিওয়েট চালক নিয়োগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। পরে ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে এসএসসি পাস ও বয়স সর্বোচ্চ ৩০ বছরের শর্ত থাকলেও কচি শেখের বয়স প্রায় চল্লিশোর্ধ্ব। নিয়োগের শর্ত অনুযায়ী তিনি এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেননি এবং আইডি কার্ড পরিবর্তন করে নিজের বয়স কমিয়েছেন বলে সাক্ষাৎকারে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
নিয়োগ বোর্ডের একাধিক সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সাক্ষাৎকারের সময় সদস্যরা অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং যোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগের পরামর্শ দেন। কিন্তু উপাচার্যের নির্দেশে আত্মীয় পরিচয় দেওয়া ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
নিয়োগ বোর্ডের সদস্য কুমিল্লা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ড্রাইভিং ইন্সট্রাক্টর সৌরিদ রায় জানান, আমি সাক্ষাৎকারে ছিলাম না। তবে প্রাকটিক্যাল পরীক্ষায় একজন প্রার্থীর বয়স বেশি ছিল। তার নাম কচি শেখ হতে পারে। কিন্তু অন্যান্য অসঙ্গতির বিষয়ে আমার জানা নেই। তবে প্রায় বছরখানেক পার হয়েছে, পুরোনো ঘটনা হওয়ায় বিষয়টি আমার সেভাবে মনে নেই।
এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রাইভার মনিরুজ্জামানের জড়িত থাকার বিষয়ে একটি অডিও রেকর্ড প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। যেখানে তিনি ড্রাইভার শাহিনুরকে উপাচার্যের কাছে গিয়ে সরি বলার পরামর্শ দেন। শাহিনুর শোকজের জবাবে কচি শেখকে উপাচার্যের আত্মীয় উল্লেখ করে ভুল করেছেন, যে কারণে উপাচার্য তার ওপর রাগ হয়েছেন। পরে শোকজের জবাবে তিনি যেন এ শব্দটির উল্লেখ না করেন সে বিষয়ে পরামর্শ দিতে শোনা যায়।
রেকর্ডের বিষয়ে মনিরুজ্জামানের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, কচি শেখ আমাকে কোনো টাকা-পয়সা দেয়নি। সার্কুলারের আগে তার সঙ্গে আমার কখনো দেখা বা কথা হয়নি। অনেক সময় মিথ্যার ছলে অনেক কথা হয় তখন হয়ত বলে ফেলেছি।
তিনি আরও বলেন, যখন ইন্টারভিউ দিতে আসে তখন একই জেলায় (গোপালগঞ্জ) বাড়ি হওয়ায় তার সঙ্গে আমার প্রথম কথা এবং পরিচয় হয়। এর আগে তার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি। আমি এবং শাহিনুরের নিয়োগ একসঙ্গে হওয়াতে আমি শুধু শাহিনুরকে বলেছিলাম তাকে আপনি গিয়ারটা দেখিয়ে দিয়েন।
এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) মো. আমিরুল হক চৌধুরীর বলেন, উপাচার্যের কোনো আত্মীয়কে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কি না আমার জানা নেই। এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক ড. মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আমি নিয়োগ বোর্ডের প্রধান নই, আপনি অন্য সদস্যদের বক্তব্য নিতে পারেন। তবে এখানে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রাকটিক্যাল পরীক্ষায় আমি ছিলাম না। যারা উপস্থিত ছিলেন তারা বলতে পারবেন। তবে কচি শেখ আপনাদের কাছে কোনো বিষয় স্বীকার করলে এটা তিনি বলতে পারবেন।
তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে উপাচার্যের দপ্তরে একাধিক দিন গেলেও তিনি প্রতিবেদককে এড়িয়ে যান। পরে মোবাইল ফোনে অন্তত ১০ বার কল দিয়ে এবং ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।
উল্লেখ্য, গত বছরের ২১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসচালক পদে সাক্ষাৎকার দিতে আসা কচি শেখকে (যিনি বর্তমানে নিয়োগপ্রাপ্ত) উপাচার্যের আত্মীয় পরিচয় দেওয়ায় বাস চালানোর নিয়মগুলো দেখার সুযোগ দেন মো. শাহিনুর রহমান (যিনি শাস্তিপ্রাপ্ত)। পরে এ ঘটনার জানাজানি হলে ২ এপ্রিল মো. শাহিনুর রহমানকে সরকারি কর্মচারী বিধি ২০১৮ এর আওতায় অসদাচরণের অভিযোগ এনে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় প্রশাসন।
পরে নোটিশের জবাবে শাহিনুর রহমান কচি শেখ উপাচার্যের আত্মীয় পরিচয় দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন এবং ১১ মে পুনরায় আরেকটি নোটিশে প্রশাসন উপাচার্যের আত্মীয় পরিচয় দেওয়ার ঘটনাকে অসদাচরণ উল্লেখ করে জবাব চায়।
এ ঘটনায় একাধিকবার শাহিনুর রহমানের জবাবের প্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর রেজিস্ট্রার আমিরুল হক চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে ‘অদক্ষতা ও অসদাচরণ’র অভিযোগ এনে শাস্তি হিসেবে মো. শাহিনুর রহমানকে গ্রেড-২ এর নিম্নতর ধাপে অবনমিত করার আদেশ দেয়।
মন্তব্য করুন