দিন শেষে শরীরের যেমন বিশ্রাম দরকার, তেমনি মনেরও দরকার শান্তি- আর সেটার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো ভালো ঘুম। কিন্তু আধুনিক জীবনের দৌড়ঝাঁপ, মানসিক চাপ, স্ক্রিনে চোখ রেখে থাকার অভ্যাস কিংবা ভুল খাবারের কারণে অনেকেই রাতের বেলা ঘুমাতে পারেন না। কেউ সহজেই ঘুমাতে পারেন না, কারও আবার মাঝরাতে বারবার ঘুম ভেঙে যায়।
ভালো ঘুম না হলে শুধু ক্লান্তি নয় এর প্রভাব পড়ে আপনার মস্তিষ্ক, হৃদয়, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা, এমনকি ওজন ও রক্তের চিনি (Blood sugar) নিয়ন্ত্রণের ওপরও।
তাই আপনার সুস্থতা ও ভালো থাকার জন্য ঘুমকে দিতে হবে গুরুত্ব। চিন্তা নেই, ঘুমের সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য কিছু সহজ ও কার্যকর উপায় রয়েছে যেগুলো বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণিত।
আজকের এ লেখায় আমরা জানব ১৫টি সহজ ও ফলদায়ক উপায়, যা আপনাকে সাহায্য করবে রাতে শান্তিতে ঘুমোতে। চলুন জেনে নিই কীভাবে প্রতিদিনের একটু পরিবর্তনে আপনি ফিরে পেতে পারেন আপনার কাঙ্ক্ষিত ঘুম।
তাই ভালো ঘুম নিশ্চিত করা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিচে ঘুম ভালো করার ১৫টি প্রমাণিত উপায় তুলে ধরা হলো:
১. প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যান ও ঘুম থেকে উঠুন
আপনার শরীরের ঘড়ি বা সার্কাডিয়ান রিদম একটি নিয়মিত ছকে কাজ করে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানো এবং উঠলে শরীর সেই অনুযায়ী অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং ঘুম সহজ হয়।
২. রাতে ফোন বা কম্পিউটার কম ব্যবহার করুন
স্ক্রিন থেকে বের হওয়া নীল আলো (ব্লু লাইট) মেলাটোনিন নামক ঘুমের হরমোনকে কমিয়ে দেয়। তাই ঘুমানোর অন্তত ২ ঘণ্টা আগে ফোন, ল্যাপটপ বা টিভি দেখা বন্ধ রাখুন। চাইলে নীল আলো প্রতিরোধক চশমাও ব্যবহার করতে পারেন।
৩. সন্ধ্যার পর ক্যাফেইন এড়িয়ে চলুন
চা, কফি বা এনার্জি ড্রিংকে থাকা ক্যাফেইন ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাতে ক্যাফেইন নিলে ঘুমের সময় প্রায় ৪৫ মিনিট কমে যায়। তাই ঘুমানোর কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা আগে ক্যাফেইন গ্রহণ বন্ধ করুন।
৪. দিনের বেলা বেশি ঘুমাবেন না
কম সময়ের পাওয়ার ন্যাপ উপকারী হলেও বেশি বা অনিয়মিত ঘুম রাতে ঘুমাতে সমস্যা করতে পারে। যদি দিনে ঘুমানোর পর রাতে সমস্যা হয়, তাহলে পাওয়ার ন্যাপের সময় কমিয়ে দিন বা বাদ দিন।
৫. মেলাটোনিন সাপ্লিমেন্ট নেওয়া যেতে পারে
মেলাটোনিন একটি ঘুমের হরমোন যা ঘুমাতে সাহায্য করে। ঘুমের আগে ০.৫–২ মিলিগ্রাম মাত্রায় এই সাপ্লিমেন্ট নেওয়া যেতে পারে। তবে অবশ্যই আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৬. ম্যাগনেশিয়ামসহ কিছু সাপ্লিমেন্ট চেষ্টা করুন
নিচের উপাদানগুলো ঘুমে সাহায্য করতে পারে:
ম্যাগনেশিয়াম
ওমেগা-৩
জিংক
রেসভেরাট্রল
নাইট্রেট
এই সাপ্লিমেন্টগুলো একসঙ্গে না নিয়ে একবারে একটি করে ব্যবহার করে দেখুন কোনটি কার্যকর।
৭. অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন
রাতের বেলা অ্যালকোহল পান করলে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। এতে শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হয়, এমনকি ঘুমের হরমোনের ওপরও প্রভাব পরে। তাই সম্ভব হলে রাতে অ্যালকোহল না পান করাই ভালো।
৮. বিছানা, গদি ও বালিশ আরামদায়ক করুন
একটি আরামদায়ক তোশক ও বালিশ ঘুমের মানের উন্নতি ঘটায়। গবেষণায় দেখা গেছে, মাঝারি শক্ত গদি পিঠে ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। তাপমাত্রা অনুযায়ী উপযুক্ত উপাদানের বেডিং ব্যবহার করুন। যেমন গরমে লিনেন, ঠাণ্ডায় উল ব্যবহার উপকারী।
৯. ঘরের পরিবেশ ঘুমের উপযোগী করুন
ঘুমের জন্য ঘর যেন শান্ত, অন্ধকার ও ঠাণ্ডা থাকে সেটা নিশ্চিত করুন। শব্দ, আলো, ধুলো, গন্ধ বা অতিরিক্ত গরম যেন না থাকে। ঘরের তাপমাত্রা ১৮-১৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাখলে বেশিরভাগ মানুষ ভালো ঘুমাতে পারেন।
১০. রাতে ভারী খাওয়া থেকে বিরত থাকুন
ঘুমানোর ঠিক আগে ভারী খাবার খাওয়া হজমে সমস্যা করে এবং ঘুমের ব্যাহত ঘটায়। চেষ্টা করুন ঘুমানোর অন্তত ২-৩ ঘণ্টা আগে রাতের খাবার খেতে। যদি দেরিতে খান, তাহলে হালকা কিছু খান — যেমন কলা, বাদাম, ওটস।
১১. ঘুমানোর আগে বেশি পানি খাবেন না
রাতে বেশি পানি খেলে ঘন ঘন বাথরুমে যেতে হয় ফলে ঘুম ভেঙে যায়। তাই ঘুমানোর ১–২ ঘণ্টা আগে পানি কম খান এবং শোওয়ার আগে একবার টয়লেট ব্যবহার করুন।
১২. ঘুমানোর আগে মনকে শান্ত করুন
মনকে শান্ত করতে পারেন বিভিন্ন উপায়ে। যেমন-
- ধ্যান বা মেডিটেশন
- হালকা বই পড়া
- হালকা সঙ্গীত শোনা
- গরম পানি দিয়ে গোসল
- গভীর শ্বাস নেওয়ার ব্যায়াম
এগুলো স্ট্রেস কমায় ও ঘুম সহজ করে।
১৩. ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানো রোগ চিহ্নিত করুন
যদি আপনার নিয়মিত খারাপ ঘুম হয়, তাহলে হয়তো ঘুম সংক্রান্ত রোগে ভুগছেন। যেমন:
- স্লিপ অ্যাপনিয়া (ঘুমের মধ্যে শ্বাস বন্ধ হওয়া)
- ইনসমনিয়া (ঘুম আসতে না চাওয়া)
- রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম
- নারকোলেপসি
এসব সমস্যা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
১৪. প্রতিদিন নিয়মিত ব্যায়াম করুন
নিয়মিত ব্যায়াম আপনার ঘুমের মানকে ভালো করে। তবে ঘুমানোর ঠিক আগে ব্যায়াম না করে দিনের শুরুতে বা বিকেলে করুন। এতে শরীর পর্যাপ্তভাবে বিশ্রাম পায়। প্রতি সপ্তাহে ১৫০ মিনিট হালকা থেকে মাঝারি ব্যায়াম করাই যথেষ্ট।
১৫. ‘১০-৩-২-১-০’ নিয়ম মেনে চলুন
ঘুম ভালো করতে এই নিয়মটি মেনে চলতে পারেন:
১০ ঘণ্টা আগে: ক্যাফেইন বন্ধ
৩ ঘণ্টা আগে: খাবার ও অ্যালকোহল বন্ধ
২ ঘণ্টা আগে: কাজ বন্ধ, রিল্যাক্স করুন
১ ঘণ্টা আগে: মোবাইল, টিভি বন্ধ
০ বার: অ্যালার্ম বাজার সাথে সাথেই উঠুন
ভালো ঘুম শুধু আরামদায়ক নয়, বরং স্বাস্থ্যকর জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। খাবার, ব্যায়াম, পরিবেশ এবং দৈনন্দিন অভ্যাস—এই চারটি জিনিসই ঘুমের মানে বড় ভূমিকা রাখে।
আপনি যদি সত্যিই নিজের সুস্থতা ও মানসিক প্রশান্তি চান, তবে ঘুমকে দিন আপনার জীবনের শীর্ষ অগ্রাধিকার।
তথ্যসূত্র: হেলথলাইন
মন্তব্য করুন