নারী শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম, প্রজনন ক্ষমতা, ঘুম, ত্বক, মন-মেজাজ এবং সামগ্রিক সুস্থতা অনেকাংশেই নির্ভর করে হরমোনের ওপর।
কিন্তু বর্তমান দ্রুতগতির জীবনধারা, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ ও পরিবেশ দূষণের কারণে বাংলাদেশি নারীদের মধ্যে PCOS (পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম বা পলিসিস্টিক ওভারি ডিজিজ), থাইরয়েড সমস্যা, PMS (প্রিমেনস্ট্রুয়াল সিনড্রোম বা মাসিক পূর্ববর্তী লক্ষণ) ও এন্ডোমেট্রিওসিসের মতো হরমোন-সম্পর্কিত সমস্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে।
তবে সুখবর হলো, সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুললে হরমোনের ভারসাম্য ধরে রাখা বা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। কিছু নির্দিষ্ট খাবার রয়েছে যেগুলো নিয়মিত খেলে শরীর স্বাভাবিক হরমোন উৎপাদন ও নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়। আজ আমরা তুলে ধরেছি এমন ১০টি গুরুত্বপূর্ণ খাবার এবং কীভাবে তা প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করবেন, যা বাংলাদেশি নারীদের জন্য সহজলভ্য ও বাস্তবসম্মত।
সবুজ শাকসবজি ও ক্রুসিফেরাস সবজি
এই সবজি লিভারকে শরীরের অতিরিক্ত ইস্ট্রোজেন (এক ধরনের হরমোন) পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। ফলে পিরিয়ড ও মুড স্বাভাবিক থাকে।
যেসব খাবার উপকারী: বাঁধাকপি, ফুলকপি, শালগম, মুলা এবং সরিষা শাক বা পালং শাক।
প্রতিদিন অন্তত একবার হালকা সিদ্ধ বা কাঁচা অবস্থায় খাওয়ার চেষ্টা করুন।
ভালো চর্বি (Healthy Fats)
হরমোন তৈরির মূল উপাদানই হলো স্বাস্থ্যকর চর্বি। এটি PMS, ত্বকের সমস্যা ও মুডের ওঠানামা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
বাংলাদেশে সহজলভ্য উৎস: কোল্ড প্রেস করা সরিষার তেল, নারকেল তেল (ভার্জিন), কাঠবাদাম, কাজুবাদাম, তিল, অলিভ অয়েল (সুপারশপে পাওয়া যায়) ও এভোকাডো (যদি পাওয়া যায়)।
প্রতিদিনের প্রতিটি বড় খাবারে এক ধরনের ভালো চর্বি রাখুন।
বিভিন্ন রঙের শাকসবজি খান
লাল, সবুজ, কমলা—প্রতিটি রঙে আছে আলাদা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা হরমোন ও অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখে।
রঙিন সবজির উদাহরণ: লালশাক, গাজর, কুমড়া, লাউ, করলা, বেগুন, টমেটো, ধনেপাতা, মেথি পাতা
দিনে অন্তত ৫-৭ রঙিন সবজি খাওয়ার চেষ্টা করুন।
উচ্চ মানের প্রোটিন
রক্তে শর্করার ভারসাম্য ও হরমোন তৈরি করতে সাহায্য করে। প্রাণিজ ও উদ্ভিজ্জ দুই ধরনের প্রোটিনই প্রয়োজন।
বাংলাদেশি উৎস: ডিম (গ্রাম্য বা ফার্ম মুক্ত), দেশি মুরগি বা হাঁস, মুগ ডাল, মসুর ডাল, সয়াবিন, ছোলা, ঘরে তৈরি পনির বা টফু
প্রতিটি প্রধান খাবারে একটি প্রোটিনের উৎস রাখুন।
তিসির বীজ (Flaxseeds)
তিসির বীজে রয়েছে লিগনানস নামে এক প্রাকৃতিক উপাদান, যা ইস্ট্রোজেনের ভারসাম্য রক্ষা করে। PCOS ও PMS-এ বেশ কার্যকর।
ব্যবহার কৌশল: প্রতিদিন ২ চা চামচ গুঁড়া করে দই, স্মুদি, খিচুড়ি বা রুটির মিশ্রণে ব্যবহার করুন। এটি সুপারশপ বা হারবাল দোকানে সহজলভ্য।
ফল খান, তবে পরিমিতভাবে
সরাসরি ফল খেলে ফাইবারসহ শরীরে যায়, যা রক্তে শর্করার ভারসাম্য রক্ষা করে।
উপযুক্ত ফল: পেয়ারা, আপেল (ভালোভাবে ধুয়ে খান), বেদানা, জাম, আমলকী, বরই ও মৌসুমি বেরি (যেখানে পাওয়া যায়)।
ফলের রস, ক্যান্ডি বা শুকনো ফল কম খাওয়া ভালো।
ভেষজ ও মসলা ব্যবহার করুন
প্রতিদিনের রান্নায় ব্যবহৃত মসলার অনেকগুলোই হরমোন ব্যালান্সে সহায়ক।
উপকারী মসলা ও ভেষজ: আদা, হলুদ, কালোজিরা, রসুন, জিরা, ধনে ও এলাচ
সাধারণ রান্নাতেই ব্যবহার করুন নিয়মিত।
সম্পূর্ণ শস্যজাত খাবার খান
সাদা চাল বা ময়দা নয়, বরং আঁশযুক্ত শস্য খাবার খেলে হরমোন ও মাসিক চক্র নিয়ন্ত্রণে থাকে।
উৎকৃষ্ট উৎস: লাল চাল / ব্রাউন রাইস, আটার রুটি, ওটস, মুড়ি / চিড়া (পরিমিত পরিমাণে) ও যব
সাদা ভাত, চিনি, পাউরুটি খাওয়া কমিয়ে দিন।
ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার
পিরিয়ডের ব্যথা, PCOS, উদ্বেগ ও ঘুমের সমস্যা কমাতে ম্যাগনেসিয়াম কার্যকর।
বাংলাদেশে যেসব খাবারে আছে: পালং শাক, কলমি শাক, কাজু, বাদাম, কলা, ডাল, আটার রুটি ও ওটস
এতে ঘুম ভালো হয়, মানসিক চাপও কমে।
পেটের জন্য ভালো ব্যাকটেরিয়া (Gut Health)
হরমোন তৈরির সঙ্গে পেটের স্বাস্থ্য সরাসরি জড়িত। তাই প্রোবায়োটিক ও আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া জরুরি।
উপকারী খাবার: ঘরে তৈরি টক দই, দেশি আচার (ফারমেন্টেড), ছোলা, ভাজা মুড়ি (প্রিবায়োটিক) ও পানতা ভাত (B ভিটামিনে ভরপুর)
সপ্তাহে অন্তত ২০-৩০ রকম উদ্ভিজ্জ খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন।
নারীদের জন্য কিছু টিপস:
- দিনে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন
- প্রক্রিয়াজাত খাবার (চিপস, বিস্কুট, সোডা) কমান
- হাঁটা, হালকা ব্যায়াম বা যোগব্যায়াম করুন
- সম্ভব হলে নিরাপদ খাদ্য বা নিজস্ব ছাদবাগানের সবজি খান
মন্তব্য করুন