

সোশ্যাল মিডিয়ায় একটু চোখ রাখলেই দেখা যায়— ‘লিভার ডিটক্স’ বা ‘লিভার ক্লিনজ’ নামে নানা হারবাল পণ্যের বিজ্ঞাপন ভাসছে। কেউ বলছে বিটরুট বা আমলকি লিভার থেকে সব টক্সিন বের করে দিতে পারে, আবার কেউ বলছে এক চামচ হারবাল পাউডার খেলেই নাকি লিভার ঝকঝকে হয়ে যাবে।
শুনতে আকর্ষণীয় লাগলেও প্রশ্নটা থেকেই যায়— এসব পণ্য আসলেই কাজ করে, নাকি উল্টো শরীরের ক্ষতি করে? চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদদের মতে, লিভার আমাদের শরীরের এমন একটি অঙ্গ যা নিজেই প্রতিদিন টক্সিন ফিল্টার করে এবং নিজেকে পরিষ্কার রাখে। তাই ‘ডিটক্স পণ্য’ আসলে কতটা দরকার, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা ভিন্নমত দিয়েছেন। চলুন বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন থেকে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, লিভার এমন একটি অঙ্গ যা শরীরের সব টক্সিন বা বিষাক্ত পদার্থকে ফিল্টার করে বর্জ্যে রূপান্তরিত করে। অর্থাৎ, একজন সুস্থ মানুষের লিভার নিজেই প্রতিদিন শরীর পরিষ্কার রাখে— আলাদা কোনো ডিটক্স পণ্য দরকার হয় না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটির হেপাটোলজিস্ট ড. টিনস্যে ওরেটা বলেন, ‘লিভার প্রতিদিনই শরীরের রক্ত ফিল্টার করে, টক্সিনকে বর্জ্যে পরিণত করে এবং শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন তৈরি করে।’
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যেভাবে বাজারে নানা লিভার ডিটক্স পণ্য বিক্রি হচ্ছে, সেটাকে তিনি ভুল ধারণা বলে উল্লেখ করেন।
ড. ওরেটা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) এসব হারবাল ডিটক্স পণ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে না, তাই এদের মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়।
বাংলাদেশের ল্যাবএইড হাসপাতালের পুষ্টিবিদ সামিয়া তাসনিম বলেন, ‘লিভার একটি স্বয়ংক্রিয় ও দক্ষ ডিটক্স অঙ্গ। অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার, অ্যালকোহল বা ভাইরাল সংক্রমণ ছাড়া সাধারণ অবস্থায় এর জন্য কোনো ডিটক্স পণ্য লাগে না।’
তার মতে, কিছু পণ্য ভুলভাবে সেবনে লিভারের ক্ষতি হতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে এটি উল্টো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
পুষ্টিবিদ সামিয়া তাসনিমের মতে, হারবাল উপাদান চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়, কিন্তু শুধু তখনই যখন সেগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত, মাননিয়ন্ত্রিত ও নিরাপদ মাত্রায় কার্যকর বলে দেখা যায়।
তিনি বলেন, বাজারে অনেক হারবাল পণ্য বিক্রি হচ্ছে কোনো প্রমাণ ছাড়াই। এগুলোর নির্দিষ্ট ডোজ, বিশুদ্ধতা বা নিরাপত্তা যাচাই করা হয় না। এ কারণে অনিয়ন্ত্রিতভাবে এসব পণ্য খেলে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বা অন্য ওষুধের সঙ্গে সংঘাত তৈরি করতে পারে।
জন্স হপকিন্স মেডিসিনের তথ্য অনুযায়ী, কিছু ভেষজ যেমন মিল্ক থিসল বা হলুদের নির্যাস লিভারের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু এসব উপাদানের নিয়মিত ব্যবহারে কোনো বৈজ্ঞানিক সুপারিশ এখনো নেই। এছাড়া গ্রিন টি, আদা, রসুন বা হলুদের মতো খাবারে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে, যা লিভারের জন্য উপকারী হলেও, এগুলো লিভার পুরোপুরি পরিষ্কার করতে পারে না।
হামদর্দ ইউনিভার্সিটির ইউনানী মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান খান বলেন, ‘যে কোনো হারবাল পণ্য ব্যবহারের আগে সঠিক ডোজ জানা জরুরি। অনেক সময় ভুলভাবে শুকানো বা সংরক্ষণের কারণে এসব উপাদানে ফাঙ্গাস বা ধুলাবালি জমে, যা উল্টো ক্ষতিকর হতে পারে।’
তার মতে, শুধু ভালো মানের ও পরীক্ষিত উপাদান সঠিক পরিমাপে ব্যবহার করলে তবেই সেগুলো উপকারী হতে পারে।
পুষ্টিবিদ তাসনিমের মতে, লিভার সুস্থ রাখার মূল রহস্য হলো স্বাস্থ্যকর জীবনধারা।
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন : অতিরিক্ত ওজন লিভারে চর্বি জমায়, যা ফ্যাটি লিভার ডিজিজের কারণ হতে পারে।
সুষম খাবার খান : অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডসমৃদ্ধ খাবার লিভারের জন্য ভালো।
অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন : অতিরিক্ত মদ্যপান লিভারের সবচেয়ে বড় শত্রু।
পর্যাপ্ত পানি পান করুন এবং নিয়মিত ব্যায়াম করুন।
ড. ওরেটা আরও বলেন, ‘লিভারকে সুস্থ রাখতে সংযমী জীবনযাপন জরুরি। অতিভোজন বা অতিরিক্ত ডিটক্স পণ্যের আশ্রয় নেওয়ার চেয়ে কম খাওয়া ও পরিমিত জীবনযাপন অনেক বেশি কার্যকর।’
চিকিৎসকদের এককথায় মত— লিভার নিজেই শরীর পরিষ্কার রাখতে যথেষ্ট সক্ষম। তাই বাজারের ডিটক্স পণ্য খাওয়ার আগে ভাবুন একবার। প্রাকৃতিক খাদ্য, ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম ও অ্যালকোহল থেকে দূরে থাকা— এই সহজ জীবনধারাই লিভারকে রাখবে সুস্থ ও কর্মক্ষম।
মন্তব্য করুন