শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাবিত প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) ফ্রান্স থেকে দেশে ফিরেছেন। বেলা ২টা ১০ মিনিটের দিকে তিনি ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান। তাকে স্বাগত জানিয়েছেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, অন্য দুই বাহিনীর প্রধান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। এরপরই তিনি বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ গণমাধ্যমের উদ্দেশে বক্তব্য প্রদান করেন।
ড. ইউনূসের পুরো বক্তব্য-
আজকে আমাদের গৌরবের দিন। যে বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ নতুন বিজয় দিবস সৃষ্টি করল সেটাকে সামনে রেখে এবং আরও মজবুত করে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
যারা এটাকে সম্ভব করেছে, যে তরুণ সমাজ, তাদের প্রতি আমি আমার সমস্ত প্রশংসা এবং কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তারা আমার পাশে আছে। এরা এ দেশকে রক্ষা করেছে, এ দেশকে পুনর্জন্ম দিয়েছে এবং এ পুনর্জন্মে যে বাংলাদেশকে পেলাম সে বাংলাদেশ যেন অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে পারে, সেটাই আমাদের শপথ। সেটা আমরা রক্ষা করতে চাই। এগিয়ে যেতে চাই।
আজকে আবু সাঈদের কথা মনে পড়ছে আমাদের। যে আবু সাঈদের ছবি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মনে গেঁথে আছে। এটা কেউ ভুলতে পারবে না। কী অবিশ্বাস্য এক সাহসী যুবক! বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
তারপর থেকে কোনো যুবক কোনো যুবতী আর হার মানেনি, সামনে এগিয়ে গেছে। তারা বলেছে, যত গুলি মারো মারতে পারো, আমরা আছি। যার কারণে এই আন্দোলন সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে গেছে এবং যার কারণে বাংলাদেশে দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা অর্জন করেছে।
এই স্বাধীনতা আমাদের রক্ষা করতেই হবে, শুধু স্বাধীনতা রক্ষা করা নয়। এই স্বাধীনতার সুফল প্রতিটি মানুষের ঘরে পৌঁছাতে হবে। তা না হলে এই স্বাধীনতার কোনো দাম নেই। এই স্বাধীনতা প্রতিটি ঘরে পৌঁছানোই আমাদের প্রতিজ্ঞা। আমাদের শপথ। আমাদের এটা করতে।
মানুষ যেন জানে, যে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অর্থ হলো তার নিজের পরিবর্তন, ব্যক্তির পরিবর্তন নয় সুযোগের পরিবর্তন, তার ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যতের পরিবর্তন। এটা যেনো প্রত্যেকে বুঝে নেয়।
আজকের তরুণ সমাজকে এটা বোঝানো যে এই দেশ তোমাদের হাতে। এটাকে তোমরা তোমাদের মনের মতো করে গড়ে তুলবে। তোমরা যেহেতু স্বাধীন করতে পেরেছ, তোমরা এটাকে তোমাদের মনের মতো করে গড়তেও পারবে। তোমাদের দেখে সারা দুনিয়া শিখবে যে কীভাবে একটা দেশকে তরুণ সমাজ গ্রহণ করতে পারে এবং তাকে পাল্টে ফেলতে পারে।
তোমাদেরকে আমি বারে বারে উপদেশ দিই, পুরোনোদের বাদ দাও। পুরোনোদের চিন্তা দিয়ে আমাদের মুক্তি হবে না। এটা শুধু দেশের কথা না, পুরো দুনিয়ার কথা বলছি।
তোমাদের মধ্যে যে শক্তি আছে, যে সৃজনশীলতা আছে, সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। শুধু বই-খাতাতে লেখার জিনিস না, এটাকে প্রকাশ করার জিনিস। এটা কে স্থাপন করার জিনিস। এটাকে অনুভব করা।
আজকে আমাদের দায়িত্ব হলো, যেটা তরুণ সমাজ অর্জন করে নিয়ে এসেছে, সেটা এখন তাদেরকে দিয়ে করিয়ে দেওয়া। আমাদের সমস্ত কাঠামোগুলো পরিষ্কার করে দেওয়া।
সরকার বলতে একটা জিনিস আছে, কিন্তু তার ওপর মানুষের কোনো আস্থা নেই। সরকার যেখানে সুযোগ পায় মানুষকে কষ্ট দেওয়া একটু নিংড়ে দেওয়া হয় সকল স্তরে। মানুষ মনে করে, সরকার হচ্ছে একটা দমনপীড়নের যন্ত্র। এটা একটা ভয়ের জিনিস, যাকে সামাল দিয়ে চলতে হবে। এটা সরকার হতে পারে না।
সরকারকে দেখে মানুষের বুক ফুলে উঠবে। মনে করতে হবে সরকার আমাকে রক্ষা করবে, সহযোগিতা করবে, আমার সরকার আমার জন্য দাঁড়াবে। কিন্তু সরকার কারো জন্য পাশে দাঁড়ায় না কোনো সময়।
এখন যে সরকার হবে, মানুষকে রক্ষা করবে সে সরকার, মানুষের আস্থাভাজন হবে। মানুষকে তোড়জোর করে সরকারকে ভালো বলাতে হবে না। মানুষ নিজে নিজে বিশ্বাস করবে যে সরকার ভালো, সরকারি লোক দেখলে বলবে যে এ আমার লোক, আমাকে রক্ষা করার লোক।
সেই আস্থাটা আমাদের ফিরিয়ে আনতে হবে মানুষের মধ্যে। তাহলে মানুষও যোগ দেবে এর মধ্যে। মানুষ এখন পিছিয়ে থাকে কিসের মধ্যে সরকার আমাদের ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আমরা যেন এখন জানতে পারি আমরা সবাই মিলে অগ্রসর হতে পারি।
সারা বাংলাদেশ একটা পরিবার। এ পরিবার আমরা একসঙ্গে চলতে চাই। আমাদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব যা কিছু আছে, সরিয়ে ফেলতে চাই। যারা বিপথে গেছে, তাদের পথে আনতে চাই। যাতে করে একসঙ্গে আমরা কাজ করতে পারি।
এর মধ্যে আসার পথে শুনলাম, এখানে আইনশৃঙ্খলার ব্যাঘাত হচ্ছে। মানুষ মানুষকে আক্রমণ করছে, ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে, সম্পদ জ্বালিয়ে নষ্ট করছে, পুড়িয়ে দিচ্ছে, অফিস-আদালতে আক্রমণ করছে, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করছে, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আহমাদিয়া সবার ওপর আক্রমণ করছে। এগুলো ষড়যন্ত্রের অংশ। এগুলো আমাদের বিষয় না।
আমাদের কাজ হলো সবাইকে রক্ষা করা। প্রতিটি মানুষকে রক্ষা করা। প্রতিটি মানুষ আমাদের ভাই, আমাদের বোন, তাদের রক্ষা করা এবং আমাদের একটা শৃঙ্খলায় ফিরে আসা উচিত। বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা এগুলো হলো অগ্রগতির বড় শত্রু।
আমাদের যে যাত্রা শুরু হলো, সে যাত্রার শত্রু। কাজেই এই শত্রুকে যাতে রোধ করা যায়, তাদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে হোক, তাদের আইনশৃঙ্খলার হাতে দিয়ে হোক, এটা বোঝাতে হবে। তাদের মেরে-পিটে ফেলা ঠিক না। আইনশৃঙ্খলা নিজের হাতে নেওয়া ঠিক না।
আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমন হতে হবে, তাদের হাতে সোপর্দ করতে হবে, এতে আমরা নিশ্চিত থাকব যে, এর একটা বিহিত হবে। এমন হলো আমরা দিয়ে দিলাম, তারা টাকা নিয়ে ছেড়ে দিলো, এটা যেন না হয়। আমাদের সেই আস্থাটা আনতে হবে। কাজেই আইন শৃঙ্খলা ঠিক করা আমাদের প্রথম কাজ। এটা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত আমরা অগ্রসরের পদক্ষেপ নিত পারব না।
আপনারা আমার ওপর আস্থা রেখে আমাকে আহ্বান জানিয়েছেন, ছাত্ররা আহ্বান জানিয়েছে। সেটাতে আমি সাড়া দিয়েছি। দেশবাসীর কাছে আমার আবেদন, আপনারা যদি আমার ওপর বিশ্বাস রাখেন, ভরসা রাখেন, তাহলে নিশ্চিত করেন যে দেশে কোনো জায়গায় কারও ওপর কোনো হামলা হবে না। এটা আমাদের প্রথম দায়িত্ব।
এটা যদি আমি করতে না পারি, আমার কথা যদি না শোনেন আপনারা, তাহলে আমার কোনো প্রয়োজন এখানে নেই। আমাকে বিদায় দেন, আমি আমার কাজে থাকি। সেটা নিয়েই আমি ব্যস্ত থাকি। আর যদি আমাকে প্রয়োজন মনে করেন, তাহলে এটা দেখাতে হবে যে আমার কথা আপনারা শোনেন। আমার কথা না শুনলে মনে করব আমার কোনো প্রয়োজন নেই।
আমার প্রথম কথা হলো, আপনারা এই বিশৃঙ্খলা থেকে দেশকে রক্ষা করেন। আপনারা সহিংসতা থেকে দেশকে রক্ষা করেন। যাতে আমরা আমাদের ছাত্রদের দেখানো পথে এগিয়ে যেতে পারি।
বাংলাদেশ একটি খুব সুন্দর দেশ হতে পারে। এটা খুবই সম্ভাবনাময় দেশ। এ সম্ভাবনাকে আমরা নষ্ট করে দিচ্ছে। এখন আবার সেই বীজতলা তৈরি করতে হবে। আবার আমাদের জেগে উঠতে হবে। ছাত্ররা এই বীজতলা তৈরি করবে। তাদের হাত দিয়েই হবে এবং তাদের দিকেই আমরা তাকাব। তাদের নির্দেশ মতো আমরা অগ্রসর হবো।
এখানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা আছেন, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর প্রধানরা যারা আছেন। তাদের প্রতিও অনুরোধ, আমরা একটা পরিবার।
এ পরিবারের মধ্যে যেন কোনো গোলোযোগ না হয়। আমরা যেন একযোগে, একসঙ্গে চলতে পারি এবং তড়িৎগতিতে একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার পথে এগিয়ে যেতে পারি। সেটা আমার কামনা।
আপনাদের সবার কাছে আমার আবেদন, আমাদের সেই সুযোগ দিন।
মন্তব্য করুন