জুলাইয়ে শহীদদের হত্যার পাশাপাশি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ত্বকী, সাগর-রুনী, তনুসহ নারায়ণগঞ্জের সব হত্যাকণ্ডের সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানিয়েছে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ। শনিবার (০৭ সেপ্টেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ আয়োজিত তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে গোলটেবিল বৈঠকে এ দাবি করেন ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি।
ছেলে হত্যার বিচারের দাবি করে তিনি বলেন, ত্বকীকে অপহরণ করা হয়েছিল। ওই রাতেই নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয় এবং এর দুদিন পর ৮ মার্চ সকালে শীতলক্ষ্যা নদীর খালের পাড় থেকে পুলিশ ত্বকীর লাশ উদ্ধার করে। সে রাতেই নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় দণ্ড বিধি ৩০২/৩৪ ধারায় আসামি অজ্ঞাত উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটির তদন্ত প্রথমে পুলিশ শুরু করলেও যখন তারা নিশ্চিত হয় এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবার জড়িত তখন তারা এ মামলার তদন্ত কার্যক্রমে অপারগতা প্রকাশ করে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে তখন মামলাটির তদন্ত-ভার র্যাবের ওপর ন্যস্ত হয়। তারা সে বছর ২৯ জুলাই ইউসুফ হোসেন লিটন এবং ১২ নভেম্বর সুলতান শওকত ভ্রমর নামে দুজন ঘাতকের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করে।
এই হত্যাকণ্ডের সঙ্গে শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমান জড়িত দাবি করে ত্বকীর বাবা বলেন, জবানবন্দিতে তারা ত্বকীকে হত্যার বিশদ বিবরণ দেয়। তাতে উল্লেখ করা হয়ে সাবেক সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের ছেলে এবং শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমানের নির্দেশে তার টর্চারসেলে ত্বকীকে রাত ১২টার আগেই হত্যা করা হয়েছে। তারা ১৭ বছরের কিশোর ত্বকীকে সকলে মিলে গজারির লাঠি দিয়ে পিটিয়ে অজ্ঞান করার পরে বুকের উপর উঠে গলা টিপে শ্বাস রোধ করে হত্যা করে। চোখ উপড়ে আনে, দেহের বিভিন্ন অংশ থেতলে দেয়। পরে আজমেরীর গাড়িতে করেই ত্বকীর লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দিয়ে সেই টর্চারসেলে ফিরে গিয়ে বিরিয়ানী খায়। ৭ আগস্ট র্যাব আজমেরী ওসমানের উইনার ফ্যাশন খ্যাত সেই টর্চারসেলে অভিযান চালায়। সেখানে তারা দেয়ালে ও আসবাব-পত্রে গুলির চিহ্ন দেখতে পান এবং সেখান থেকে রক্তমাখা প্যান্ট, দড়ি, রক্তমাখা গজারির লাঠি, ইয়াবা সেবনের সরঞ্জামাদি, পিস্তলের অংশসহ বিভিন্ন বস্তু আলামত হিসেবে সংগ্রহ করেন।
তিনি বলেন, ত্বকী হত্যার ১ বছরের মাথায় ২০১৪ সালের ৫ মার্চ র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল হাসান র্যাবের প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ত্বকী হত্যার রহস্য উদঘাটনের দাবি করে বলেছিলেন আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ১১ জন মিলে ত্বকীকে হত্যা করেছে। হত্যার কারণ হিসেবে তারা তিনটি বিষয়কে উল্লেখ করেন।
তারা বলেন, ‘এক : ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বির সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে শক্ত অবস্থান গ্রহণ, দুই : এর কিছু দিন পূর্বে গণপরিবহনে শামীম ওসমান ও তার অনুগত লোকদের ব্যাপক চাঁদাবাজীর বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলন গড়ে তোলা, তিন : চিহ্নিত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ভূমি দখলের প্রতিবাদে জনগণের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া। এ তিনটি কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে তারা ত্বকীকে হত্যা করেছে বলে উল্লেখ করে র্যাব একটি অভিযোগপত্র তৈরি করে তা উপস্থিত সাংবাদিকদের সরবরাহ করেন। র্যাব তখন অচিরেই এ অভিযোগপত্র আদালতে পেশ করা হবে বলে জানিয়েছিল। কিন্তু এর তিন মাস পরে ৩ জুন ২০১৪ জাতীয় সংসদে এই নিয়ে বিভিন্ন কথা হওয়ার পর ত্বকী হত্যার সব তদন্ত কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, আমরা দীর্ঘ সাড়ে ১১ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জ সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিচারের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছি। বিচারের দাবিতে বিশ্বের ২১টি দেশে প্রতিবাদ হয়েছে। দেশের বিশিষ্টজনেরা ত্বকীকে নিয়ে লিখেছেন, দেশে ও দেশের বাইরে কবিতা লেখা হয়েছে, গান রচনা করা হয়েছে, কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে, ত্বকীর কবিতা ও ত্বকীকে নিয়ে লেখা কবিতার আবৃত্তির ক্যাসেট প্রকাশিত হয়েছে। বিচারের এই দাবিকে রুদ্ধ করতে শামীম ওসমান বিভিন্নভাবে আমাদের উপরে হামলা, নির্যাতন চালিয়েছে। আমাদের বাড়ি-ঘরের ইট খুলে ও হত্যা করার হুমকী দিয়েছে। আমার বিরুদ্ধে ৭ টি মামলা দিয়েছে, ত্বকীর মামলা করার কারণে আইনজীবী প্রদীপ ঘোষ বাবুকে হুমকি দিয়ে তার চেম্বারে হামলা চালিয়েছে। ১৬৪ ধারায় নাম আসার পরেও আজমেরীকে কখনো গ্রেপ্তার করা হয় নাই। বরং জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য আজমেরী পুলিশের সহায়তায় হোন্ডা-বাহিনী নিয়ে, গাড়ির বহর নিয়ে শহর দাপিয়ে বেড়িয়েছে। তার পোষ্টার-বিলবোর্ডে শহর সবসময় ছেয়ে রয়েছে। আমরা বরাবরই বলে এসেছি ত্বকী হত্যার নির্দেশদাতা শামীম ওসমান। শামীম ওসমান তার ছেলে ও ভাতিজাকে দিয়ে ত্বকীকে হত্যা করিয়েছে। এ হত্যার সঙ্গে জড়িত সবাইকেই আইনের আওতায় এনে আজকে আমরা বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন- বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী জতির্ময় বড়ুয়া, আব্দুল হাই শিকদার, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, আমিনুল হকসহ আরও অনেকে।
মন্তব্য করুন