ডেঙ্গু রোগের জীবাণুবাহী এডিস মশার উৎস ধ্বংস করতে বাসাবাড়ির বেজমেন্টেও নতুন কীটনাশক বিটিআই ছিটানো হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।
কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে চলার মধ্যে মশা নিয়ন্ত্রণে দেশে প্রথমবারের মত এই ওষুধ ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি। এই কীটনাশকের পুরো নাম ব্যাসিলাস থুরিংয়েইনসিস ইসরায়েলেনসিস। এটি প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট একটি ব্যাকটেরিয়া, যা মাটিতে পাওয়া যায়। ১৯৭৫ সালে ইসরায়েলের একটি পরিত্যক্ত পুকুরে প্রথম এই ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এই কীটনাশক ব্যবহার করছে। বিটিআইয়ের ব্যবহার আছে সিঙ্গাপুরেরও। ভারতের কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটি ১৯৯৬ সাল থেকে বিটিআই ব্যবহার করছে।
সোমবার (৭ আগস্ট) থেকে জৈব কীটনাশক মাঠ পর্যায়ে ছিটানোর কাজ শুরু হয়েছে। বনানীর ৪৭ নম্বর সড়কের পাশে গুলশান লেকে বিটিআই ছিটানোর মধ্য দিয়ে এই কার্যক্রম উদ্বোধন করেন মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।
আরও পড়ুন : ঘরোয়া উপায়ে মশা তাড়াবেন যেভাবে
উদ্বোধন শেষে মেয়র আতিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, মশা নিয়ে জরিপে তথ্য অনুযায়ী যত লার্ভা পাওয়া যায় তার ৪৩ শতাংশই মেলে বাড়ির বেইজমেন্টে। এজন্য এসব জায়গায় বিটিআই প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিএনসিসি।
এ কাজে নগরবাসীর সহায়তা চেয়ে তিনি বলেন, বেজমেন্ট আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যদিও বেইজমেন্টে ওষুধ দেওয়া আমাদের কথা না। কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা দেব। আমি নগরবাসীকে অনুরোধ করছি আপনারা আমাদের সাহায্য করবেন আমরা যেন বেইজমেন্টে গিয়ে বিটিআই দিয়ে আসতে পারি।
মেয়র বলেন, বিভিন্ন দেশে এ ধরনের জৈব কীটনাশক বেসরকারি পর্যায়ে ব্যবহার করতে পারে। এটা যদি ফার্মেসিতে অ্যাভেইলেবল হয়, তাহলে যে কেউ এটা কিনে ব্যবহার করতে পারবে। আমি অনুরোধ করব যারা এ ধরনের ব্যবসা করতে চান তারা বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন। সিটি করপোরেশন তো ব্যবসা করবে না।
আতিকুল ইসলাম বলেন, এটা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিন। গত ৪০ বছর ধরে ঢাকায় মশার লার্ভা ধংসে টেমিফস ওষুধ ব্যবহার করা হত। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত পাশের দেশ ভারতেও বিটিআই ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশেও কীটতত্ত্ববিদসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার পর বিটিআই ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তারা আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন বিটিআই আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। অনেক প্রক্রিয়া শেষে বিটিআই আনা হয়েছে। আজ এটার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রয়োগ শুরু হয়েছে।
মেয়র বলেন, বিটিআই প্রয়োগের সুফল পেতে সঠিকভাবে পরিমাপ করাটা জরুরি। এজন্য আগামী পাঁচদিন এ বিষয়ে ডিএনসিসির কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এরপর থেকে ওয়ার্ড পর্যায়ে ছিটানো হবে ওই জৈব কীটনাশক। এর মিশ্রণ তৈরির একটা মাপ আছে, দশ লিটার পানিতে ৩টা প্যাকেট অর্থাৎ ৭৫ গ্রাম বিটিআই দিতে হবে। এক গ্রাম বিটিআই ছিটাতে হবে এক স্কয়ার মিটার এলাকায়। ৭৫ গ্রাম ওষুধ ৭৫ স্কয়ার মিটার জায়গায় দিতে হবে, এটা নিশ্চিত করাই মূল বিষয়। এই অংকটা শেখা, ৭৫ মিটার জায়গার জন্য কয়টা স্টেপ দিতে হবে জানা জরুরি। এসব বিষয়েই প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে তাদের।
তিনি বলেন, যতদূর জেনেছি, এটা পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না। মানুষের এমনকি যারা ওষুধটা প্রয়োগ করবে তাদেরও ক্ষতি করবে না। আমি যেসব জায়গায় গেছি, তারা আমাকে বিটিআই প্রয়োগের পরামর্শ দিয়েছে। আমেরিকার ফ্লোরিডার কয়েকটি শহরে বিটিআই প্রয়োগ হচ্ছে মশা নিয়ন্ত্রণে। আমরা মশা নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করছি। এর অংশ হিসেবে বিটিআই ভালো কাজে দেবে বলে আশা করি।
ঢাকা উত্তর সিটি জানিয়েছে, বিটিআই কীভাবে ব্যবহার করতে হবে সে বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিতে রোববার সিঙ্গাপুর থেকে সরবরাহকারী কোম্পানির একজন কর্মকর্তা ঢাকায় এসেছেন। আগামী পাঁচদিন তিনি মশক নিয়ন্ত্রণকর্মী এবং কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেবেন। সিঙ্গাপুর থেকে এরইমধ্যে পাঁচ টন বিটিআই আনা হয়েছে।
বিটিআই এর একটি প্যাকেটে ২৫ গ্রাম কীটনাশক থাকে। ১০ লিটার পানিতে এরকম তিন প্যাকেটের ৭৫ গ্রাম কীটনাশক মিশিয়ে ২৫ থেকে ৫০ বর্গমিটার এলাকায় ছিটিয়ে দিতে হয়। কোনো স্থানে প্রথমবার দেওয়ার ১৫ দিন পর আবার বিটিআই প্রয়োগ করতে হয়। সিঙ্গাপুর বেস্ট কেমিকেল কোম্পানি লিমিটেড থেকে কেনা এই কীটনাশকের প্রতি কেজির দাম ৩ হাজার ৩৮৫ টাকা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম মোস্তফা সারওয়ার কালবেলাকে বলেন, আমাদের দেশে এটা একদমই নতুন। এজন্যই আমরা সিঙ্গাপুর থেকে ওই লোককে এনেছি। তিনি আমাদের দেখাবেন কীভাবে, কতটুকু ওষুধ, কোথায়, কতটুকু জায়গা নিয়ে প্রয়োগ করলে ভালো কাজে আসবে।
আরও পড়ুন : মশা মারার নতুন ‘কামান’ বিটিআই কতটা কার্যকর
জাহাঙ্গীরগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার কালবেলাকে বলেন, যেসব জায়গায় এখন বিটিআই ব্যবহার হচ্ছে সেখানে এটা বেশ কাজে দিচ্ছে। ঢাকাতেও এটা কাজে দেবে আশা করা যায়। তবে সঠিকভাবে, সঠিকমাত্রায়, সঠিক জায়গায় সঠিক সময়ে প্রয়োগ করা গেলে বিটিআই ভালো ফলাফল দেয়।
এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রাজধানীতে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৫ হাজার ৬০১ জনে। এর মধ্যে ঢাকায় মারা গেছেন ২৪৮ জন। চলতি আগস্ট মাসের প্রথম ছয়দিন সারা দেশে ডেঙ্গুতে ৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিদিন ১০ জন বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে ডেঙ্গুতে।
মন্তব্য করুন