গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ করতে চলেছে বাংলাদেশ। গত বছরের এ দিন তথা ২০২৪ সালের ২১ জুলাই সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পুনর্বহাল-সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় বাতিল করে দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এতে ৭ শতাংশ কোটাব্যবস্থা রেখে বাকি ৯৩ শতাংশ পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ এবং সরকারের নির্বাহী বিভাগকে অনতিবিলম্বে প্রজ্ঞাপন জারি করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ দিন দেশজুড়ে কারফিউয়ের মধ্যেই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হয়। এতে সারা দেশে অন্তত ১৯ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০ জন এবং নরসিংদীতে ৪, গাজীপুরে ২, নারায়ণগঞ্জে ১, সাভারে ১ ও চট্টগ্রামে ১ জনের নিহতের খবর পাওয়া যায়। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ হয়। এতে কয়েকশ আন্দোলনকারী আহত হন। তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা সংকটাপন্ন ছিল। এছাড়া ২১ জুলাই সিদ্ধিরগঞ্জে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১৯ গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়।
২০২৪ সালের ২১ জুলাই সারা বাংলাদেশে চতুর্থ দিনের মতো বন্ধ ও কারফিউ বলবৎ ছিল। এদিন ভোরে ঢাকার পূর্বাচল এলাকায় আন্দোলের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে পাওয়া যায়। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর আগে ১৯ জুলাই রাত আড়াইটার দিকে রাজধানীর খিলগাঁও থেকে তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের করা লিভ টু আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে এ বিষয়ে শুনানি শুরু হয়। শুনানি শেষে দুপুরে রায় ঘোষণা করা হয়। এতে সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল-সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় সামগ্রিকভাবে বাতিল (রদ ও রহিত) করা হয়।
রায়ে বলা হয়, কোটাপ্রথা হিসেবে মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ; মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ; ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হলো। তবে নির্ধারিত কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কোটার শূন্য পদগুলো সাধারণ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করতে হবে। এই নির্দেশনার আলোকে সরকারের নির্বাহী বিভাগকে অনতিবিলম্বে প্রজ্ঞাপন জারি করতে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ।
আপিল বিভাগের এ রায়কে স্বাগত জানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ সময় আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম জানান, আপিল বিভাগের রায়কে শিক্ষার্থীরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তবে নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত হিসেবে দেখছেন তারা। এ ছাড়া রায়ের পর শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তবে চার দফা দাবি পূরণে ৪৮ ঘন্টা সময় বেঁধে দেন। চার দফা দাবির মধ্যে ছিল- কারফিউ তুলে দেওয়া, ইন্টারনেট পরিষেবা চালু করা, বিশ্ববিদ্যালয় ও আবাসিক হল খুলে দেওয়া এবং আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
এদিন আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচারসহ আট দফা দাবি দ্রুত বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে সরকারকে আহ্বান এবং ২২ জুলাই (সোমবার) গায়েবানা জানাজা কর্মসূচির ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ২২ জুলাই কারফিউ বলবৎ থাকবে। দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল থাকবে। ঢাকা জেলা ও মহানগর, গাজীপুর জেলা ও মহানগর এবং নারায়ণগঞ্জে কারফিউয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জেলা প্রশাসকরা পরিস্থিতি বিবেচনা করে কারফিউয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
এ ছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আন্দোলনকালীদের দেখা মাত্র গুলি করার নির্দেশ দেয়। এমন পরিস্থিতে রাজধানীর বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, কুড়িল ও মিরপুর এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। অন্দোলনকে কেন্দ্র করে কয়েক দিনের সংঘর্ষ, গুলি, হামলা ও সহিংসতার ঘটনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে মামলা হয়। এসব মামলায় গত পাঁচ দিনে ঢাকায় প্রায় ২০০ জনসহ সারাদেশে অন্তত ৫৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে ছিলেন বেশিরভাগ ছিলেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা।
এ দিনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি পক্ষ ৯ দফা দাবি জানিয়ে শাটডাউন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। এছাড়া ২১ জুলাই সন্ধ্যার পর থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গণমাধ্যমকে নিহতের তথ্য দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়।
মন্তব্য করুন